ইতিহাস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ বা এক্কেবারে প্রাথমিক উপাদান প্রত্নতাত্বিক উপাদান। যার মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের ইতিহাসের এক সঠিক ছবি লিপিবদ্ধ সম্ভব। সত্যি বলতে ইতিহাস মানে তো গল্প নয়, তা অতীতের কিছু বাস্তবিক ঘটনার মেলবন্ধন। যাই হোক, এখন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও যোগাযোগ, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে অনেক আবিষ্কার এবং পুরাতাত্বিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া সহজ - এমনকি তার গবেষণালব্ধ তথ্য সহজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রায় ১০০ বছর আগে পরিস্থিতি এমন আদৌ ছিল না। আর সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যাঁর উদ্যমের কোনো অভাব ছিল না, তিনি রয়ে গেছেন প্রচারের আড়ালে, বা বলা চলে মিডিয়ার বাড় -বাড়ন্ত তখন এত বেশি না থাকায় তাঁর এই অন্তরাল। আজ সেই মানুষটির কথাই জানাবো। প্রত্নতাত্বিক উপাদানের সংগ্রহ, সর্বোপরি ঢাকা মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ও স্তম্ভ ছিলেন যে মানুষ তাঁর গল্পই হোক সকলের অনুপ্রেরণা।
সময়টা ১৮৮৮ সালের ২৪শে জানুয়ারী। বর্তমান বাংলাদেশের অধীন মুন্সীগঞ্জ জেলায় জন্ম হয়েছিল কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, লিপিবিশারদ, মুদ্রাবিজ্ঞানী এবং পণ্ডিত ব্যক্তি নলিনীকান্ত ভট্টশালীর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রত্নবস্তুর নেশায় তাঁর সন্ধান ও গবেষণা পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯১২ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়েসে তিনি পুরনো ঢাকার নর্থব্রুক হলে বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের সামনে এক বক্তব্যে প্রত্নবস্তুর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাঁর যথাযথ সংরক্ষণে ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের গুরুত্ব যুক্তি-তথ্য দিয়ে তুলে ধরেন। এই যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে প্রীত হয়ে লর্ড কারমাইকেল তাঁকে ২০০০ টাকা পুরস্কার প্রদান করে মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠায় সম্মতি জানান। ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর স্থাপন করেন লর্ড কারমাইকেল। তাঁর অনুরোধে ১৯১৪ সালে সেখানে নলিনীকান্ত ভট্টশালী কিউরেটর পদের দায়িত্ব নিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হওয়া পর্যন্ত তিনি ওই পদেই কর্মরত ছিলেন। ডক্টরেট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
তাঁর এই ইতিহাস সন্ধানের প্রতি তাগিদ যে কি সাংঘাতিক ঘটনাবহুল ছিল তা বলা বাহুল্য। প্রত্নতত্ত্বের নেশায় তিনি উত্তরবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গের নানা জায়গায় ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন। তখন পরিবহন এত উন্নত ছিল না। নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দমে যাননি তিনি। এইভাবে সংগ্রহ করেছেন প্রচুর মূর্তি, তাম্রশাসন, মুদ্রা, পুঁথি। সন্ধান পেয়েছেন কোনো এক গ্রামের গ্রামবাসীরা এক প্রাচীন মূর্তির গুরুত্ব না বুঝেই সিঁদুর লাগিয়ে পুজো করতে শুরু করছে। ঢাকা জাদুঘর থেকে নলিনীকান্ত ভট্টশালী সেটিকে সংগ্রহ করতে গেলেন। কিন্তু গ্রামবাসীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েও তিনি দমেন নি। বললেন, জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে সেই মূর্তি পুজো করবেন তিনি। তখন গ্রামের মানুষেরা সরল বিশ্বাসে সেটি তুলে দিতেন তাঁর হাতে। এমন আরো কতই না ঘটনা।
বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের ওপর নলিনীকান্তের বেশ কিছু মূল্যবান বই রয়েছে যা আজও গবেষকদের কাছে সমাদৃত। নলিনীকান্ত ভট্টশালীর নাম খুব বেশি প্রচারের আলোয় আসেনি, কিন্তু বঙ্গদেশে প্রত্নতত্ত্ব গবেষণার আদি পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি, এই নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। সর্বোপরি ঢাকা মিউজিয়ামের সাথে তাঁর আত্মিক যোগসূত্র মৃত্যুর এতদিন পরও এখনো অমলিন আছে। প্রত্নতত্বের এই পথপ্রদর্শকের প্রতি শ্রদ্ধা না হয় এই স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই থাকলো।