ডি এম। মানে, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট নয়; ধীরেন মুখার্জি। নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজের ইকোনোমিক্সের টিচার। মেজাজটি যদিও তাঁর সংক্ষিপ্ত নামেরই উপযুক্ত, তবে ভদ্রলোক ভীষণ ভালো পড়ান। চটিতে আওয়াজ তুলে হাঁটেন। আওয়াজ ক্রমে নিকটবর্তী হতে থাকলে বোঝা যায়, তিনি আসছেন।
তো, সেদিন যখন সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে ছবি আঁকা চলছিল ব্ল্যাকবোর্ডে, আঁকছিলেন চণ্ডীচরণ লাহিড়ী, সংক্ষেপে, চণ্ডী লাহিড়ী নামের এক ছাত্র; ঠিক তখনই শোনা গেল ক্লাসের দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে চটির সেই পরিচিত আওয়াজটি। অমনি ঝটপট ছবি আঁকা শেষ করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে সটান নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লেন চণ্ডী। ভাবখানা, যেন কিচ্ছুটি হয়নি। তাঁর চোখেমুখে কৌতুক। ক্লাসের সবাই ভয়ে অস্থির, ডি এম দেখলে রেখে গিয়ে কি যে করবেন কে জানে! অথচ, চণ্ডী--নিমাইয়ের নবদ্বীপের ছেলে তিনি, তেরো বছর বয়স থেকেই বিপ্লবীদের সঙ্গ করেছেন, পুলিশ-প্রশাসনের ভয় উপেক্ষা করে তাদের খাবার পৌঁছে দিতে গেছেন, বোমা বাঁধতে গিয়ে বাঁ হাত হারিয়েছেন; তাঁর আবার ভয় কি? ক্লাসের সবার চোখ তাঁর ওপর, সে চোখে রাগ। চণ্ডী আঁকে ভালো, কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক; তাই বলে তার জন্য সবাইকে উদোম বকা খেতে হবে, এ তো ঠিক না! ওকে তো বারণ করা হলো আঁকতে, তবুও শুনল না! ওর জন্য আমরা ভুগব কেন! ঠিক যখন এই বস্তুবাদী দ্বন্দ্ব অনেকের মনে চলছে, তখনই ক্লাসে ঢুকলেন ডি এম। ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই ব্ল্যাকবোর্ডটিকে মুছে ফেলা তাঁর অভ্যেস। এগোলেন সেদিকে এবং এগিয়েই থমকে গেলেন। ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে জ্বলজ্বল করছে একটি কার্টুন। আগের দিন তিনি ক্লাসে টাকার উপযোগিতা ও তার ব্যবহার-বিষয়ে যে লেকচারটি দিয়েছিলেন; সেটাই চকের রেখায় সাদা-কালো 'কার্টুন' হয়ে শোভা পাচ্ছে ব্ল্যাকবোর্ডে। তলায় ইংরেজিতে একটি ক্যাপশনও রয়েছে--'Eat drink and be merry'. তাঁকে থমকাতে দেখে পুরো ক্লাস স্তব্ধ, যাকে বলে, পিন ড্রপ সাইলেন্স। একদিকে যেন ঝড় ওঠার আগের মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, অন্যদিকে দুরুদুরু বুকে চলছে সেই ঝড় সয়ে নেবার প্রস্তুতি। আর ঠিক তখনই ভেসে এলো ডি এম-এর গম্ভীর কণ্ঠ, "কে এই শিল্পী জানি না, কিন্তু আমি তার প্রশংসা করি। চমৎকার হয়েছে। Utility of money-র ব্যাখ্যা। এর চেয়ে ভাল আমিও করতে পারতাম না। যিনিই এর শিল্পী হোন না কেন, তাঁর অনুমতি নিয়ে আমি ছবিটা মুছে ফেলছি। কর্তব্যের প্রয়োজনেই অবশ্য।" তিনি মুছতে শুরু করলেন। সবাই অবাক। অমন মেজাজি লোকটার হল কি আজ! গলায় রাগ নেই, বকাঝকা নেই! তবে, তাঁর কথাগুলো অকুণ্ঠ প্রশংসা, না শ্লেষ--সেটা বোঝা গেল না। সে যাই হোক, ফাঁড়া যে কেটেছে, সেটাই যথেষ্ট। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো।
আর সকলের কাটলেও চণ্ডীর ফাঁড়া বোধহয় কাটল না। কারণ, ছুটির ঘন্টা পড়তেই বেছে বেছে ডাক পড়ল একা চণ্ডীর। টিচার্স রুমে। গুটি গুটি পায়ে গেলেন সেখানে। ডি এম তখন সেখানে একা। ভণিতা না-করে সরাসরি বললেন, "দেখো চণ্ডীচরণ, ছবি আঁকা জিনিসটা খুব ভালো। তুমি যতই ভিজে বেড়াল সেজে বসে থাকো না, ওটা যে তুমি এঁকেছিলে সেটা আমি বিলক্ষণ জানি। I admire your attempt, but not courage. টেস্ট সামনেই। কোর্স এখনও শেষ হয়নি, এ সময়টা নিশ্চয়ই ছবি আঁকার উপযুক্ত সময় নয়। পরীক্ষা শেষ করে ডিগ্রিগুলো নিয়ে তারপর জীবন ভোর ছবি এঁকো, আপত্তি করবো না।" কথাগুলো বলার মধ্যে কোথাও এতটুকু উষ্মা রইলো না, বরং একরাশ ভালোবাসা আর পিতৃপ্রতিম স্নেহ ঝরে পড়ল তার ছত্রে ছত্রে। চণ্ডী বুঝলেন, কথাগুলো মাথায় করে রাখার মতো। রাখলেনও।
কলেজ পত্রিকায় সম্পাদনা-কাজে চণ্ডীর হাতেখড়ি। আঁকাতেও। কর্মজীবন শুরুও হল সেই সম্পাদনা দিয়ে, পাঁচের দশকে, 'দৈনিক লোকসেবক' পত্রিকায়। বেশ কয়েক বছর হল, বিদেশের অনুসরণে সচিত্র পত্রিকা প্রকাশের ধুম পড়েছে। তাতে নিয়মিত অলংকরণের ছবি এবং কার্টুন-প্রয়োজন। কাজেই, শুরু হল 'সচিত্র ভারত', 'হসন্তিকা', 'প্রভাত তরী' প্রভৃতি পত্রিকায় চণ্ডীর কার্টুন আঁকা। ঠিক এই-পর্বেই দারুণ একটা সুযোগ পেলেন তিনি। 'হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকায়, 'বক্স কার্টুন' আঁকার। 'থার্ড আই ভিউ' নাম দিয়ে শুরু হল আঁকা। এবং, সেইসঙ্গে হয়ে উঠলেন এদেশে 'বক্স কার্টুন'-এর পথিকৃৎ। তবে, তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি এনে দিল 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র 'তির্যক'। এবার ছায়াছবিও তাঁর প্রতিভার স্পর্শ পেল। 'মৌচাক', 'চারমূর্তি'-র মতো ছবির মজাদার টাইটেল-এনিমেশন যেমন করলেন, তেমনি বাড়িতে বসে ফ্রেমের পর ফ্রেম হাতে এঁকে নির্মাণ করে ফেললেন, 'Under the Blue Moon'-নামের কার্টুন ছবিটি। সে ছবি বাংলার কার্টুন ছবির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করলো। এর সঙ্গে কার্টুন দিয়েই যে অন্য চোখে ভারত-দর্শন করানো যায়, সেটা প্রমাণ করে দিলেন, তাঁর 'Visit India with Chandi' বিখ্যাত বইটির মধ্য দিয়ে। কার্টুনিস্ট হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তিনি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সামাজিক অসঙ্গতির সঙ্গে কোনদিন আপোষ করলেন না। এমনকি, পিকাসোর মতোই নিজেকে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়লেন না। সৃষ্টি করলেন--টাক মাথা, ধুতি পরা, নিজের অল্টার ইগো, 'বুড়ো' চরিত্রটি। আসলে, সৃষ্টি-সাগরে আন্তর্জাতিক ভাবনার মধ্যেও নিজস্ব রেখা-শৈলীতে 'বাঙালিয়ানা' হয়ে উঠল তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ।
তথ্য ঋণ:
একালের কার্টুন--কুমারেশ ঘোষ সম্পাদিত