একসময় বাংলার শিশুর দিন কাটত রাতের অপেক্ষায়। রাত হওয়া মানেই তো স্বপ্নের হাতছানি। পাতালপুরী ভ্রমণ। দুয়োরানীর বর্ণনা শুনে ঠাকুরমার বুকে মুখ গুঁজে আশ্রয়। আরও কত স্মৃতি! আনন্দ-বদনা-প্রাপ্তি-বঞ্চনার আলেখ্য আজও বিলি কেটে যায় মনের দরজায়। ঘুমপাড়ানিয়া রূপকথা। শৈশবসঙ্গী সেইসব এক একটা রূপকথার বয়স হাজার বছরেরও বেশি। গ্রামবাংলার এই ভুলে যাওয়া কাহিনিগুলোই একত্রিত হয়ে জন্ম দিয়েছিল বাঙালির কল্প লোকের। যেখানে ভূমিকা লিখতে কলম ধরেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
আর যিনি প্রায় এক দশক ঘুরে বেড়িয়েছেন এইসব গল্পের উৎস সন্ধানে তিনি শৈশবে মাতৃহীন। স্কুল পালানো দুরন্ত কিশোর। লোককবি ও লোককাহিনির সান্নিধ্যে বাংলার মেঠো আত্মার আবেদন মিশেছিল তাঁর লেখনীতে। একসম়য় এই সঞ্চয় বগল দাবাই করে এসে উঠলেন শহরে। তখন স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে। আর তাঁর লেখাতেও তো সেই স্বদেশের আর্তি। শিশুর মন ভোলানো রূপকথা আর ম্যানচেস্টারের ছাপাখানা থেকে আসবে না। দেউলিয়া স্বদেশের কোলে লুকানো মণিমানিক্যের থলের সন্ধান পাওয়া গেল সেদিন। বলেছিলেন কবিগুরু।
অভিনব ভাষারীতি, প্রত্যন্ত পল্লির পালাপার্বণ-যাত্রা-কথকতার সরস প্রবাহ সেই সৃষ্টির আকর। কিন্তু দোরে দোরে ঘুরলেন তিনিও। আসলে যে কোনও ঐতিহাসিক সৃষ্টির ভাগ্যেই বোধ হয় এই অবমাননা জোটে। ঠাকুরমার ঝুলি। তিনি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। পড়াশুনোয় মন বসে না। কানে বাজে কুসুমকুমারী দেবীর পরশভরা কণ্ঠে গল্প মায়ের আসর। মায়ের অকাল গমনে পিসিমাই সেই কল্প সূয়ার চালিকা। স্বপ্নের ময়ূরপঙ্খী তাই উড়তে পেরেছে একসময়। শুধু মায়ের চলে যাওয়াই নয়, তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন অনেক আপনজন। স্ত্রী ও পুত্র বিয়োগের যন্ত্রণাও ধাক্কা দিয়েছিল দেশজ রূপকথার জনককে।
"যেদিন প্রথম আমায় ডেকে তোমার চিঠি/ এল, এখনো সেই দিনটি আসে তোমার স্পর্শ / মেখে।
...
ইচ্ছে করে, প্রথম দিনের কথা আর আজেয়/ কাহিনী মিশিয়ে, তোমায় চিঠি লিখি। "
গানের পাশাপাশি কবিতাতেও স্বভাবসিদ্ধ তিনি। বিশ্বকবির বন্দনায় লিখেছিলেন এই লাইনগুলো। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলায় প্রথম বই হাতে পেয়ে দৌড়ে যাওয়া শিশুর ছবি। সেটাও যেন এক চিঠি। এক একটা রাত মিথ হয়ে জন্ম দিত নতুন সকালের। গল্পের ভেলায় চেপে আজ সেই স্বপ্নকারের জন্ম দিবস।