শিশুর কল্পনায়, কবির কৌতূহলে উজ্জ্বলতম নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

৬ অগ্রহায়ন ১৩২৫। বেদনা যে কত গহন, কত গভীর হতে পারে, চোখের জল যে হতে পারে কতটা লবনাক্ত, পানিতরের একটা রাত বুঝিয়ে দিয়েছিল বিভূতিভূষণকে। মারন জ্বর ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে কেড়ে নিল ডাকসাইটের মোক্তার কালীভূষণ মুখার্জীর স্ত্রী এবং কন্যা তথা বিভূতিভূষণের নবপরিনীতা স্ত্রী গৌরীদেবীকে।

শারদ উৎসবের আবহে উদভ্রান্ত পাগলপারা বিভূতিভূষণ দেখলেন, দিন কয়েক আগেই কলেজ স্ট্রিটের কমলালয় থেকে কিনে দেওয়া চওড়া লাল পেড়ে শাড়িটা পরে চিরনিদ্রায় শায়িতা তাঁর স্ত্রীকে।

প্রকৃতির কোলে সান্ত্বনা খুজে ফেরেন বিভূতিভূষণ। ইচ্ছামতীর পাড়ে- নীল কুঠির মাঠে- কাশ ফুলের বনে বনে। এমন সময় আর এক বিপর্যয়। মর্মবিদারী নিদারুণ দুঃসংবাদে ব্জ্রাহত তিনি। সন্তান হতে গিয়ে প্রয়াত ছোট বোন মনি।

দিশেহারা বিভূতিভূষণের পাশে দাঁড়ালেন কলকাতার আবাসিক বন্ধুরা। তাঁকে তাঁরা কলকাতায় নিয়ে এলেন। তবু তিনি তাঁদের আগল ভেঙে কখনো বেরিয়ে পড়েন।অস্ফুট যন্ত্রণায় তাঁর মন নিতান্ত অধীর।

এমন সময় ঘটল সেই অলৌকিক ঘটনা। টালিগ্নজের কাছে পুঁটিয়ারির পথে, দেখা মিলল এক শাস্ত্রজ্ঞ সন্নাস্যীর। ব্যাকুল বিভূতিভূষণকে তিনি শোনালেন অবিনাশী আত্মার কথা। তাঁকে উপনিষদের বাণী স্মরণ করিয়ে দিলেন।

বাকরুদ্ধ, স্তম্ভিত, আকৃষ্ট বিভূতিভূষণ শুনলেন বৃহাদরণ্যকে জনক সভায় কীভাবে মহর্ষি আত্মা-তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন, ব্রহ্ম সূত্রে কীভাবে অশরীরী  আত্মার বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

প্রয়াতা স্ত্রী সন্দর্শনে উন্মুখ বিভূতিভূষণ সেই সন্ন্যাসীর কাছে নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তিনি তাঁকে প্ল্যানচেটে আত্মা আবাহন কৌশল শিখিয়ে দিলেন।

FotoJet - 2019-11-01T200210.588

কিন্তু আশ্চর্য! দিন কয়েক পরেই সেই সন্ন্যাসীর খোঁজ করতে গিয়ে আর তাঁকে পেলেন না বিভূতিভূষণ।

নিজেই পরলোক চর্চা শুরু করলেন। গেলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে, যার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যানি বেসান্ত। এ সময় থিওসফিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র।স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি নিজে কথা বলতেন তাঁর আত্মার সঙ্গে। স্ত্রী আত্মা কে ইচ্ছেমতো আনবার শক্তিও তিনি আয়ত্ব করেছিলেন। এখানে পরাবাস্তববাদী বিভূতিভূষণ আত্মা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। দেশ বিদেশের নানা গ্রন্থ, পত্র পত্রিকা পেলেন। শাস্ত্রজ্ঞানী মহাজনদের সান্নিধ্যে চলল আলোচনা, চক্রাধিবেশন, প্ল্যানচেট-মিডিয়ামের আসর। পড়লেন প্যারীচাঁদের লেখা ‘on the soul’ বইটি। হিন্দু স্পিরিচুয়্যাল ম্যাগাজিন  পত্রিকায় খবর পেলেন  দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , শিবচন্দ্র বিদ্যারত্ন, শিশির কুমার ঘোষের প্ল্যানচেট- চর্চার। এখানেই তিনি জানলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্ল্যানচেটে মিডিয়ামে বসেছেন এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখের আত্মাকে আবাহন করে এনেছেন।

নিতান্ত সাংসারিক প্রয়োজনে হুগলীর জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দিলেন  বিভূতিভূষণ। সেখানেও চলতে লাগল পরলোক চর্চা, প্ল্যানচেটের আসর। সেখানকার চাকরি হারিয়ে এলেন হরিনাভি- রাজপুরের অ্যাংলো স্যান্সক্রিট ইনস্টিটিউশনে। সেখানেও পরলোকচর্চা থেমে থাকেনি। ক্রমে পরলোক নিয়ে তাঁর বিশ্বাসের কথা এসে পড়েছে তাঁর গল্পে, উপন্যাসে।

FotoJet - 2019-11-01T200141.266

বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণী দেবীর পিতা ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যচর্চা করতেন। তিনি তান্ত্রিক ছিলেন। দীক্ষা নেন এক ভৈরবীর কাছে।‘তারানাথ তান্ত্রিক’ তাঁরই আদলে গড়া। এছাড়া বিভিন্ন দিনলিপির পাতায় , ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ ও ‘দেবযান’ উপন্যাসে বিভূতিভূষনের পরলোক বিশ্বাসের প্রসঙ্গ রয়েছে। এমনকি তাঁর লেখা প্রথম ছোটগল্প  ‘উপেক্ষিতা’তেও ছিল অপার্থিব ছায়া।

পরলোক চর্চা সম্বন্ধীয় বই পড়ার আগ্রহে বিভূতিভূষণ বনগাঁর বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের হাজার খানেক ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহটি ব্যবহার করেন। এখানেই তিনি ডব্লু, স্টিড- এর আফটার ডেথ (লেটার ফ্রম জুলিয়া), উইলিয়ম স্যান্টম মোজেস- এর ‘স্পিরিট টিচিংস’, সিমন ন্যু ক্যাম্বর- এর ‘রেমিনিসেন্স অব অ্যান অ্যাসট্রোনমার’ প্রভৃতি বই পড়ার সুযোগ লাভ করেন।

শোনা যায়, শিশু তারাদাস টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে পিতা বিভূতিভূষণ সন্তানের মাথার কাছে কাউকে বসে থাকতে দেখেন এবং নিজের জীবনের মূল্যে তাঁর প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে নেন।

জীবনের উপান্তে ২৫ অক্টোবর, কার্তিকের আট তারিখ কোজাগরি পূর্নিমার দিন ঘাটশিলায় স্থানীয় সরকারি চিকিৎসক সুবোধকুমার বসুর বাড়িতে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় বিভূতিভূষণ মৃত্যুর ইঙ্গিতসূচক বক্তব্য রাখেন। পরিশেষে আবৃত্তি করেন-

“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,

      সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,

যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,

      যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,

মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,

      দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা

           তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

                এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।।”

 

সেই সংবর্ধনার দু’দিন পর বিভূতিভূষন বিকেলবেলা বেড়াতে গিয়েছিলেন অরণ্য পরিবৃত তাঁর প্রিয় পাহাড় ধারাগিরিতে। ক্রমে দ্বিতীয়ার চাঁদ উঠেছে আকাশে। রহস্যময় বনপথে শাল, পিয়াল, আমলকী গাছের ফাঁক দিয়ে অপার্থিব চাঁদের আলো এসে পড়েছে। কন্টিকারী ঝোঁপের মাদকতাময় আঘ্রান।

বহুক্ষণ একটা পাথর খন্ডে বসে থাকার পর হঠাৎ মন্ত্র মুগ্ধের মতো এগিয়ে চলেন বিভূতিভূষণ। লরিবাংলোর ভক্তদা, কানুমামা প্রমুখ সহচরের নিষেধ অগ্রাহ্য করে নিতান্ত আবিষ্টের মতো। সকলকে পিছনে ফেলে সেই জনহীন বনভূমিতে তিনি দেখলেন একটি খাটিয়া পাতা রয়েছে। তাতে নতুন কাপড়ে ঢাকা রয়েছে কোনো মৃতজন। নীচে নতুন সরায় সিঁদুর কলা সাজানো। কাপড়টা যেন কার ইঙ্গিতে খুলে ফেলে তিনি দেখলেন নিজেরই মুখ। উপলব্ধি করলেন তাঁকে অচিরেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। বিষণ্ণ হেসে সঙ্গীদের জানালেন, নিদ্রিত আব্রাহাম লিঙ্কন ঠিক এমনই তাঁর মৃতদেহ দর্শন করেছিলেন মৃত্যুর আগে। জাগ্রত দর্শন তাঁর ক্ষেত্রেই ঘটল।

১৫ কার্তিক, বুধবার, ১৩৫৭, ইংরেজি ১৯৫০, ১ নভেম্বর অনন্ত লোকের পথে যাত্রা করলেন চিরপথিক বিভূতিভূষণ। ডায়েরির পাতায় তাঁর এই ইচ্ছের কথাই মুদ্রিত রয়েছে- ‘ নিত্য নতুন তোমার সৃষ্টিরলীলা দেখে বেড়াব, এই তো চাই।’

প্রেতলোক ছাপিয়ে তাঁর সাহিত্যে ঘটেছে অধ্যাত্মিকতার প্রকাশ। সেই অধ্যাত্মিক জীবনেরই তিনি অনুপম সন্ধানী।

  

 

 

   

 

    

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...