রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে খুব বেশি নয়, 'ক্ষুধিত পাষান', 'কাবুলিওয়ালা', 'অতিথি'-মাত্র তিনটি ছবি করেছিলেন পরিচালক তপন সিংহ। কিন্তু, কমবেশি তিনটে ছবিই সুবিখ্যাত। আর রবীন্দ্রনাথের গান? তারও সার্থক চিত্রায়ন করেছেন বিভিন্ন সিনেমায়। গানের ভেতর দিয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর আপন হয়েছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর অন্তরে। প্রেরণা নিয়ে, প্রতিষ্ঠা হয়ে। রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে 'কাবুলিওয়ালা' ছবি করেই তিনি প্রথম অর্জন করেছিলেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি। আর রবীন্দ্রনাথকে অর্জন করেছিলেন অতি শৈশবেই।
বছর ছয়েক বয়স। হ্যাঁ, যে বয়সের স্মৃতি মানুষের মনে থাকে, তখন তাঁর সেই বয়স। তারাভরা রাত। শূন্য ছাদ। মা গান শেখাচ্ছিলেন গোপাদিকে। 'যতবার আলো জ্বালাতে চাই'। মায়ের নাড়ী বেয়ে তপনের রক্তে যে গান। তাই গান এসে সেই বয়সেও তাঁর প্রাণে এসে লাগল। একটু একটু করে প্রাণের আকর হতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর একদিন মায়ের কাছে তিনিও কণ্ঠে পেলেন রবীন্দ্রনাথকে। তেমনি তারাভরা আকাশের নীচে। ঢালা বিছানার ছাদে। মায়ের কাছে শিখলেন প্রথম গান, 'কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না'।
রবীন্দ্রনাথ স্কুলের বন্দিশালা থেকে গৃহশিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে মুক্তি পেয়েছিলেন; আর তপন মুক্তি পেলেন গৃহশিক্ষকের খপ্পর থেকে বেরিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে তবেই। গৃহশিক্ষককে তপনের একটুও ভালো লাগে না। না, ভদ্রলোক পড়ান ভালো, মানুষও খারাপ না। কিন্তু, তাঁর মহাদোষ হল, তিনি বেসুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। মায়ের সুকণ্ঠে গান শুনে যাঁর কান ও কণ্ঠ তৈরি, সেই তপন এটা সহ্য করেন কেমন করে! ফলে, মানুষটাকে আর সহ্য হল না। আর যাঁকে সহ্য হয় না, তাঁর সান্নিধ্যই তো বন্দিশালা। মন্দের ভালো, ন'বছর বয়সে এসে সেই বন্দিদশা ঘুচল যা হোক।
১৯৩৩ সাল। ভর্তি হলেন ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে। ক্লাস ফোরে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সে স্কুলের হেডমাস্টার। তিনি বেহালা বাদক, রবীন্দ্রপাগল। অসম্ভব ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথের গান। স্কুল শুরুর আগে ছাত্রদের যে নিত্য প্রার্থনা হয়, তাতে তিনি রবীন্দ্রনাথের গানই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। 'জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।' গানটি তাঁর এত প্রিয় যে, শুধু স্কুলের ছেলেদের গাইয়ে তাঁর শান্তি হয় না। স্নানের ঘাটে এক একদিন ছেলেপিলে জুটিয়ে গানটি সমবেত কণ্ঠে গাইয়ে তবে ছাড়েন। সর্বত্রই নিত্যসঙ্গী তাঁর বেহালা। স্নানের ঘাটেও। ফলে, সেখানেও তিনি সঙ্গত করেন।
হঠাৎ একদিন সাঁতার কাটতে গিয়ে একটি নীচু ক্লাসের ছেলে গঙ্গায় ডুবে মারা গেল। সেই মর্মান্তিক মৃত্যুতে পরের দিন স্কুল হল, কিন্তু ছেয়ে রইল শোকের ছায়া। প্রার্থনাসঙ্গীতের দ্বিতীয় পংক্তিতে এসে সেই শোকের ছায়া কতটা গভীর সেটা টের পেলেন তপন। 'যে ফুল ফুটিতে, ঝরেছে ধরণীতে/যে নদী মরুপথে হারালো ধারা...।'-তে এসে তিনি দেখলেন বেহালা বাজাতে বাজাতে হেডমাস্টারমশাইয়ের বন্ধ চোখের আগল ঠেলে ঝরে পড়ছে অঝোরধারায় অশ্রু। দৃশ্যটি তাঁর মনে আজীবনের জন্য আঁকা হয়ে রয়ে গেল। মন বুঝল রবীন্দ্রনাথের অন্তরগলানো গান শোকে-দুঃখে অবলম্বন হয়ে স্তবের মতোই অন্তর শুদ্ধ করে।
সে-বার স্কুলের জ্যামিতিস্যার দ্বিজেনবাবুর টাইফয়েড হল। ফলে, অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুলে আসা বন্ধ করা ছাড়া তাঁর আর উপায় রইল না। তিনি না-হয় আসতে পারবেন না; কিন্তু, তাঁর ক্লাস নেবেন কে? না, কারুর ওপর চাপিয়ে দিলেন না, কাউকে অনুরোধও করলেন না; সে ভার আপনা থেকেই মাথায় তুলে নিলেন সকল কাজের কাজী হেডমাস্টারমশাই। তবে জ্যামিতির ক্লাসে তিনি যখন এলেন তখন অঙ্কের বই নয়, হাতে নিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথের 'চয়নিকা'। ক্লাসে ঢুকেই কোন ভণিতা না-করে একেবারে শুরু করে দিলেন তাঁর সুললিত কণ্ঠে কবিতা পাঠ। প্ৰথমে কাহিনি-কবিতা, 'পুরাতন ভৃত্য'। তারপর একে একে অন্যান্য কাহিনি-কবিতাগুলোর পাঠও হল নানান দিনে। কবিতায় কাহিনি শুনতে শুনতে ছাত্ররা যেমন কবিতায় মজল, তেমনি মজল রবীন্দ্রনাথেও। অন্যদের মতো একই অবস্থা হল তপনেরও। হেডমাস্টারমশাইয়ের হাত ধরেই হল তাঁর ও তাঁদের "প্রথম রবীন্দ্রবর্ণপরিচয়"। দিনে দিনে পরিচয় যত গভীর হল, আত্মীয়তা ততই বাড়ল। তাই কয়েক বছর পর, ১৯৪১ সালের শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ যখন ভাগলপুরে পৌঁছল, তখন তপন পেলেন আত্মীয়বিয়োগের ব্যথা। দেখলেন, শোকস্তব্ধ একটি শহর। যে শহরের নাম, ভাগলপুর।
ছাত্রজীবন গেল, তপন হলেন, চিত্রপরিচালক তপন সিংহ। 'কাবুলিওয়ালা' তাঁর চতুর্থ ছবি। রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে প্রথম ছবি। আগের তিনটে ছবিতে মোটামুটিভাবে পরিচালক হিসেবে পরিচিতি পেলেও 'কাবুলিওয়ালা'-র জন্য বাংলা তো বটেই, এই প্রথম সারা ভারতে বিপুল সমাদর পেলেন। এমনকি বার্লিন ফেস্টিভ্যাল থেকেও ডাক পেলেন। সেখানেও খুব সমাদৃত হল ছবি। রবিশঙ্কর পেলেন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার। তপন সিংহ-পরিচালিত ছবিতে এই প্রথম এলো আন্তর্জাতিক সম্মান। ছবির প্রধান অভিনেতা ছবি বিশ্বাস পেলেন অভাবনীয় সংবর্ধনা।
বার্লিনের চলচ্চিত্র উৎসবটিতে অরুন্ধতী মুখার্জিও গিয়েছিলেন একজন ভারতীয় অতিথি হিসেবে। তিনি সুগায়িকা, সুঅভিনেত্রী; অরুন্ধতী দেবী-নামে সর্বজন পরিচিত। তাঁর সঙ্গে তপনের তেমন আলাপ ছিল না, এখানে এসে বাড়ল। ফলে, পার্কের বেঞ্চিতে বসে যখন এক সন্ধেয় একান্তে তাঁদের আলাপ জমল; তখন তপন অনুরোধ করে বসলেন একখানা গান শোনানোর জন্য। সবার সঙ্গে অরুন্ধতীর মেজাজ মিলত না, আলাপের সুরবাহারে তপনের সঙ্গে বোধ হয় মিলল। কেননা, অনুরোধ রক্ষিত হল। শোনালেন, "পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে'। দীর্ঘকাল পরে তপন লিখেছেন, "বার্লিনের সেই সন্ধ্যায় এক গানেই মাত করেছিলেন অরুন্ধতী। আমিও কাত হয়ে গেলাম, তার পরের ইতিহাসে শ্রীমতী অরুন্ধতী মুখার্জি হলেন শ্রীমতী অরুন্ধতী সিংহ।" এভাবেই, বাল্যে-যৌবনে-ছবিতে-স্মৃতিতে-স্বপ্নে-সম্মানে-প্রেমে-বিবাহে জীবনের প্রতিটি ক্ষণ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ যেন ঈশ্বরের মতো, জীবনীশক্তির মতো অন্তর্নিহিত হয়ে, লগ্ন হয়ে থেকেছেন ব্যক্তিমানুষ ও পেশার-মানুষ তপন সিংহের সঙ্গে। জীবন বেদের নিরুক্ত হয়ে তাঁকে ঋদ্ধ করেছেন...
তথ্যঋণ : 'মনে পড়ে' - তপন সিংহ।