তাঁর সমকালে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘বক্তব্যজীবী’ লেখক হিসেবে। আসলে তিনি এক অলীক মানুষ। যাঁর সৃষ্টির দিকে তাকালে কেবল আশ্চর্য হতে হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।
সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী ও আনোয়ারা বেগমের প্রথম সন্তান সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। জন্ম ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর। মুর্শিদাবাদে। গ্রামের নাম খোশবাসপুর। ছোটবেলায় দারকা নদীর তীর তাঁকে বড় টানত। নদীর অববাহিকায় ঘাসভরা জমি, জঙ্গল জীবনের অন্য নেশায় মাতিয়েছিল তাঁকে। ন’ বছর বয়সে মাতৃহারা হন। মায়ের অভাব সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে, কারণ ততদিনে নিজেকে মিশিয়ে ফেলছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে। বাহ্যিক বিষয় নিয়ে অদ্ভুত উদাসীনতা। কিন্তু জীবনের প্রতি, বেঁচে থাকার প্রতি টান দুরন্ত। চোখের সামনে উত্তাল চারপাশ। গোষ্ঠী দাঙ্গা, রক্তপাত, হত্যা, হিংসা একদিকে আর একদিকে উন্মুক্ত প্রকৃতি। শান্ত, নির্জন। সন্ন্যাসী মায়ায় জড়িয়ে ধরে। দুই বিপরীত পারিপার্শ্বও প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। জীবন হয়ে উঠেছিল বর্ণময়।
পড়তে ভালোবাসতেন। তবে সিলেবাসের ধরাবাঁধা পড়া নয়, প্রকৃতির মতোই পড়াশোনার ক্ষেত্রটিও উন্মুক্ত। পারিবারিক লাইব্রেরীতে কাটিয়ে দিতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। বংশপরম্পরায় ছিল বইয়ের সংগ্রহ। আরবি, ফারসি, উর্দু, এমনকি হাতে-লেখা পান্ডুলিপি পর্যন্ত।
অকৃপণ প্রকৃতিই তাঁকে জীবন দেখতে শিখিয়েছিল অন্য রকম দৃষ্টিতে। এক অন্য বোধ মিশেছিল জীবন দর্শনে। একদিন ঘর ছাড়লেন, যোগ দিলেন আলকাপের দলে। তাঁর পরিচয় তখন ‘সিরাজ মাস্টার’। দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম, দুমকার বিভিন্ন অঞ্চলে। স্কুলে পড়ার সময় এক সাঁওতাল বন্ধু হয়েছিল। নাম কালিয়া। কালিয়ার কাছে সিরাজ বাঁশি বাজানো শিখেছিলেন। আলকাপের দলে কাজে লেগে গিয়েছিল ছোটবেলায় শেখা বাঁশি।১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তাঁর আলকাপ জীবন। গণনাট্যের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১০৫০ সালে বিএ পাশ করেন। সেখানেই লেখালেখির শুরু। বহরমপুর শহরের ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকায় প্রথম গল্প লেখেন ‘কাঁচি’। চাকরিও পেয়ে গিয়েছিলেন। মেদিনীপুরের পানিপারুলে সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে। কয়েকমাস করেছিলেন সেই চাকরি। ১৯৬৪ থেকে তিনি কলকাতায়।
তাঁর পাকাপাকিভাবে লেখার জগতে আসার কাহিনীও তাঁর লেখা গল্পের মতোই। চেনা ছকের বাইরে। ছোটবেলা থেকেই ঘর পালানো বাঁধন ছাড়া মানুষ। একদিন প্রেমে পড়লেন হোসনে আরা বেগমের। বিয়ের পর নবপরিনীতা ঘরে এসে দেখেন ঘর ভর্তি অজস্র কবিতার খাতায়, গল্পের পান্ডুলিপিতে। তাঁর নিজের কথায়, "মনে মনে ভাবলাম - যার এত লেখালেখির ঝোঁক, তাহলে কেন সে গানের দল নিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাবে।" আমি বললাম - "তুমি সাহিত্যিক হবে, তাহলে গান-থিয়েটার ছেড়ে, লেখায় মন দাও। গল্প লেখ, ছোটগল্প। তোমার লেখার অসুবিধে যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা আমি করব। তুমি শুধু লিখবে"।
লেখায় মন দিয়েছিলেন সিরাজ। তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস ‘কিংবদন্তীর নায়ক’।
সংস্কৃত, আরবি এবং ফার্সি ভাষা - তিন ভাষাতেই দক্ষ ছিলেন। উর্দু জানতেন। তাঁর সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল ভাষার আধারে। মুস্তাফা সিরাজ প্রায় আড়াইশো বই লিখেছেন। লেখা এবং লেখকের চেনাছকের শ্রেণিবিভাগে তাঁকে ফেলা যায় না। মায়া আর বাস্তবতার মিশেলে লিখন তাঁর অলৌকিক। কবিতা থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, রহস্য উপন্যাস সব কিছুতেই তাঁর কলম ছুটেছে তড়িৎ গতিতে।
সিরাজের কলম অতি তীব্র। মুহুর্তে ছারখার করে পাঠককে। ভবঘুরে টানে মিথ্যে হয়ে যায় ঘরজীবন। লোভ দেখায় পথে নামার। যা উদ্দাম তাকে স্পর্শ করার। তার কোনও পাপ পুণ্য হয় না।
কেবল আকুল অভিলাষ। এক দুর্গম রহস্যময় পৃথিবীতে বারবার অভিসারে নিয়ে যায় সিরাজী কলম।
(তথ্যঋণঃ কালিকলম, পরবাস, নির্বাসিত বৃক্ষে ফুটে আছে)