টকটকে ফর্সা রঙ। অভিজাত চেহারা। ঝিকমিক তারার মতো চোখ। প্রথম দেখায় অনেকেই মনে করতেন তিনি বোধহয় বিদেশি।
ডাকনাম ‘সিতারা’। চলতি কথায় সে নাম হয়ে গেল ‘সিতু’।
বাবার চাকরি ঘুরে ঘুরে। তাই ঘুরতে হত পরিবারকেও। এহেন সিতু ভর্তি হল লাল মাটির দেশের আশ্রম স্কুলে। পেল সেই স্কুলের ‘গুরু’মশাইয়ের সঙ্গ। জ্ঞান অঞ্জন শলাকায় বদলে গেল তার দেখার দৃষ্টি। সেদিনের ষোড়শ কিশোর হয়ে উঠলেন দেশ- বিদেশের ‘সৈয়দ মুজতবা আলী’।
আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম দিন। দেখা করতে গেলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। নতুন ছাত্রকে কবি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ কী পড়তে চাও?’
ছাত্র উত্তর দিল, ‘ তা তো ঠিক জানিনে, তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভাল করে শিখতে চাই’।
তিনি বললেন, “ নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী?”
উত্তর এল, ‘ মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনও জিনিস বোধ হয় ভালো করে শেখা যায় না।‘
গুরুদেব চুপ। এক দৃষ্টিতে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ এ কথা কে বলেছে?”
ছাত্র থতমত খেয়ে বলল, ‘ কনান ডয়েল’
শুনে গুরুদেব বললেন, “ ইংরেজের পক্ষে একথা আশ্চর্য নয়”।
গুরুদেবের কাছে সেই ছিল তাঁর প্রথম শেখার পাঠ। এক মুখী নয়, জীবন হতে হবে বহুমুখী।
সারাজীবন সেই ছিল তাঁর জীবন দর্শন। তাঁর জীবনের স্রোত আগাগোড়াই বয়ে গিয়েছে বহুমুখী ধারায়। নিত্য নতুন রঙে রঙিন হয়েছেন রসিক মানুষটি।
শান্তিনিকেতনে পা রাখেন ১৯২১ এর জুলাই মাসে। খাতায় কলমের নথি বলছে ছাত্র ছিলেন ৫ বছর।
আশ্রম জীবনে মুজতবার দুষ্টুমির গল্প কিছু কম ছিল না।
একবার হঠাৎ ছুটি হয়ে গেল আশ্রমের পাঠে। গুরুদেব দিয়েছেন ছুটির নোটিশ। হঠাৎ ছুটিতে ছাত্রদের খুশির অন্ত নেই। কিন্তু কেন যে ছুটি তাতেই সবাই অবাক। শেষে জানা গেল ছুটি কাণ্ডের নেপথ্যে সিতুর কারসাজি। সে-ই গুরুদেবের হাতের লেখা নকল করে পাঠিয়েছিল ছুটির চিঠি!
১৭ বছরের নবীন ছাত্রটিকে একটি মাত্র বাক্যে যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, সেই শিক্ষাকে সৈয়দ সাহেব আজীবন ধারণ করেছিলেন নিজের রক্তের ধারায়। রবির আলোয় ভরে নিয়েছিলেন চোখ। বৃহৎ পৃথিবীর ব্যাপ্তিতে।
বহু ভাষায় সুপন্ডিত। আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, জার্মান, রুশ, ইতালিয়ান মিলিয়ে প্রায় ১৮ টি ভাষা জানতেন।
সংস্কৃত ভাষায় প্রবল ব্যুৎপত্তি ছিল। বেদান্ত এবং গিটার পাঠ নিয়েছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রীর কাছে।
ভীষন স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের হাতে গড়েছিলেন প্রিয় ছাত্রকে।
সৈয়দ সাহেব রসিক মানুষ। লেখার রসদে সব ধরনের রস মিলেছিল অনাবিল রঙ্গে। কিন্তু প্রখর ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট কথা বলতেন দ্বিধাহীন ভাষায়। তার দামও দিতে হয়েছিল। জীবনের শেষ পর্ব অবধি।
তাঁর জীবন বয়ে গিয়েছিল খামখেয়ালি স্রোতে। কোনও ঘাটেই নৌকা নোঙর বাঁধেনি।
কলকাতা শহরের ওপর জন্মেছিল তীব্র অভিমান। এই শহর বিমুখ করেছিল তাঁকে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন দুম করে। ফিরে এসেছিলেন এই শহরের কাছেই। সালটা ১৯৫৭।
দুর্বল শরীর। কর্মহীন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা। কোনও ভরসাই পেলেন না মহানগরীর কাছে। শেষ পর্যন্ত ফিরে গেলেন। গুরুদেবের ভূমিতে। বাড়ি ভাড়া নিলেন শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে।
ওই সময়েই এক চিঠিতে অমলেন্দু সেনকে লিখেছিলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে একটি বাসা ভাড়া করে বাড়ি করেছি। অর্থাৎ এ স্থান আমি জীবনে ত্যাগ করতে চাইনে। দিবারাত্র সেই প্রার্থনাই করছি। এখানে এসেছি মৃত্যুর জন্য তৈরি হবার জন্য। পেটের ভাতের জন্য লিখতে হবে। সেইটুকু লিখবো। এবং কোনোদিন যদি লেখা বন্ধ করেও পেটের ভাত জোটে তবে চেষ্টা করবো, বই-পড়া থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য। আমি এ জীবনে কলকাতা আর পারতপক্ষে যাবো না...