জুডাস যেমন পুরস্কারের লোভে যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল শাসকের হাতে, তেমনি গৈরোলা গ্রামের নেত্র সেন ধরিয়ে দিয়েছিল বিপ্লবী সূর্য সেনকে। ১৯৩৩ সালে। তখন ইংরেজ সরকার মাস্টারদার মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা। এতগুলো টাকার লোভ নেত্র সামলাতে পারেনি। পুরস্কার সে পেয়েছিল, কিন্তু, ভোগ করেছিল তার স্ত্রী! ঘটনাটা ঘটেছিল এভাবে :
ঘোষিত পুরস্কার আনতে যাওয়ার দিন সকাল সকাল মনের আনন্দে খেয়েদেয়ে নেত্র বেরিয়ে গেল শহরের পথে। তখন তার পাতেই খেতে বসার জন্য স্ত্রী ভাত বেড়ে ঘরে গেল মাছের বাটি আনতে। কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। কিন্তু, সেই কয়েক মুহূর্ত পরে ফিরেই সে যা দেখল, তাতে আতঙ্কে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে সে জ্ঞান হারাল। কী দেখল সে? সে দেখল--ভাতের থালা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, আর তাতে বসানো রয়েছে নেত্র সেনের কাটা মুণ্ডু! কিন্তু, সে যা দেখতে পেল না, তা হল--থালার রক্তের মধ্যে একটা চিরকুটও রয়েছে, তাতে লেখা--'সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার--মৃত্যু!' সেদিন কে যে এই প্রতিশোধ নিয়েছিল, তার নাম আর কোনদিন জানা যায়নি!
চট্টগ্রাম ছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মভূমি। তাই এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সশস্ত্র বিপ্লববাহিনী। হাতের তালুর মতো এই চেনা অঞ্চলটিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছিল তাঁর বৈপ্লবিক কার্যকলাপ। একের পর এক প্রত্যাঘাতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদের যুদ্ধের অধিনায়ক সূর্য সেন ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজদের। তাই ১৯২৫ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের মাথার দাম যেখানে ছিল হাজার টাকা, ১৯৩৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল দশ হাজারে।
যেদিন সূর্য সেন ধরা পড়লেন, সেদিন কি হয়েছিল, আসুন দেখি :
ফেরারী আসামী সূর্য সেন গৈরোলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। ক্ষীরোদের বাড়িতে থাকলেও মাস্টারদার জন্য খাবার আসে গ্রামেরই আর এক বিপ্লবী ব্রজেন সেনের বাড়ি থেকে। ব্রজেনের সৎ-দাদা নেত্র। নেত্রর স্ত্রী রান্না করে আর ব্রজেন তাই লুকিয়ে আনেন।
সূর্য সেনের সঙ্গে একদিন ছদ্মবেশে দেখা করতে এলেন বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। সঙ্গে জুটলেন মনি দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, সুশীল দাশগুপ্ত। ফলে, ব্রজেন এদিন বেশি খাবার আনতে গিয়ে চোখে পড়ে গেলেন নেত্রর। তার সন্দেহ হল। বউকে খুঁচিয়ে সে জেনে নিল সূর্য সেনের আত্মগোপনের খবর। ব্যস, চোখে ঝিলিক মেরে উঠল লোভ। অমনি সে খবর দিতে ছুটল থানায়।
রাতে খেতে বসে হঠাৎ শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল সূর্য সেনের। গা গুলিয়ে উঠল তাঁর। যা খেয়েছিলেন সব বমি করে ফেললেন। তাঁর হল কী! ব্রজেন চিন্তিত হয়ে পাশের ঘরে ছুটলেন বমির ওষুধ আনতে। আর তখনই জানলা বেয়ে তাঁর চোখ গেল বাইরে। একটা লণ্ঠনের আলো, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে নেত্রর মুখ। সে যেন বাড়ির সামনে লণ্ঠনের আলো উঁচু করে ধরে কাউকে সিগন্যাল দিচ্ছে! কিন্তু, কাকে? কেন? তবে কি...মুহূর্তে ব্রজেনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল! আবছা আলোয় দেখতে পেলেন এগিয়ে আসছে ক্যাপ্টেন ওয়ামসলি! শুনতে পেলেন অনেকগুলো বুটের চাপা শব্দ! ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হল না। তক্ষুনি ছুটে এসে মাস্টারদাকে জানালেন, বিপদ হাজির!
হঠাৎ উত্তেজনায় খাবার ফেলে তড়াক করে তিরের মতো সোজা হয়ে গেলেন সকলে। বমিটা হয়ে গিয়ে শরীরটা হালকা হয়েছে, সেইসঙ্গে অস্বস্তিভাবটাও কেটে গেছে মাস্টারদার। তিনি ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। প্রথমেই সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তারপর তিনটি দলে ভাগাভাগি হয়ে লড়াই করার কৌশল বুঝিয়ে দিলেন। মনি-কল্পনা, শান্তি-সুশীল, মাস্টারদা-ব্রজেন--এই তিনটি দল। ইতিমধ্যেই পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। তাই পরিকল্পনামাফিক পেছনের দরজা দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে এলেন তাঁরা। সামনে বাঁশের উঁচু একটা বেড়া। আর তারপরই বড় একটা বাঁশ ঝাড়। তাঁদের লক্ষ্য সেপাইদের প্রতিহত করতে করতে বেড়া ডিঙিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া। সবাই চেষ্টা করছেন নিজেদের মতো করে সেপাইদের ব্যস্ত রেখে যে-করেই হোক মাস্টারদাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা। কারণ, মাস্টারদা ধরা পড়ে গেলে বিপ্লবের এই বেগবন্যা স্তব্ধ হয়ে যাবে। তিনিই কর্ণধার, তিনিই তারিণী, তাঁর মতো আর কেউ নেই। কিন্তু, সঙ্গীরা যা ভাবলেন, তা হল না। হঠাৎ অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে দলছুট হয়ে গেলেন সূর্য সেন। দলছুট হয়েও তিনি ছুটলেন বেড়াটার দিকে। প্রায় বেড়াটার সামনে এসে পড়েছেন, এমন সময় ক্যাপ্টেনের নির্দেশে সেপাইরা একটা রকেট ছুঁড়ল আকাশে। সেই রকেটের আলোয় মনি দেখতে পেলেন মাস্টারদাকে। মনি এগিয়ে গেলেন তাঁকে বেড়া টপকাতে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু, মাস্টারদার কাছে যাবার আগেই একটা গুলি এসে লাগল তাঁর হাতে। অতর্কিত এই আঘাতে মনি হাত চেপে পড়ে গেলেন। ওদিকে ব্রজেনও দেখতে পেয়েছিলেন মাস্টারদাকে।মনিকে পড়ে যেতে দেখে তিনি ছুটে গেলেন মাস্টারদার কাছে। অনেক কষ্টে বেড়া টপকে ওপারে নামলেন। কিন্তু, তাঁরা নামতেই কয়েকজন সেপাই যেন তৈরি হয়েই ছিল, তারা সচেতন হবার কোন সুযোগ না-দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ল এই দুজনের ওপর। ব্রজেন ও মাস্টারদা দুজনেই পড়ে গেলেন। অসম্ভব লড়াই করেও এতজনের বিরুদ্ধে কিছুতেই পেরে উঠলেন না; ধরা পড়ে গেলেন তাঁরা।
তারপর? যা হয়, বিচারের নামে প্রহসন হল। সূর্য সেনের ফাঁসির আদেশ হল। তাঁর সঙ্গে ফাঁসির আদেশ হল আর একজনের, তিনি তারকেশ্বর দস্তিদার। মাস্টারদার প্রতিটি পদক্ষেপের বিশ্বস্ত সহচর, নির্ভীক বীর বিপ্লবী; তিনিও মাস্টারদা ধরা পড়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ধরা পড়েছিলেন।
১৯৩৪, ১১ জানুয়ারি। ১২-এর ভোরে ফাঁসি হবে। হ্যাঁ, ভোর--এযাবৎকালের এটাই তো নিয়ম। কিন্তু, ভীত ইংরেজের কাছে সে নিয়মও বদলে গেল। ১১-এর রাতে পাশাপাশি সেলে বন্দি সবার উদ্দেশ্যে যে শেষ ভাষণ উচ্চৈঃস্বরে সূর্য সেন দিয়েছিলেন, তাতে দারুণ এক উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছিল সবার মধ্যে, মুহুর্মুহু ধ্বনিত হচ্ছিল শতকণ্ঠে 'বন্দে মাতরম' মন্ত্র। সেই উন্মাদনা দেখে ইংরেজের চাকরেরা আর স্থির থাকতে পারল না, মাস্টারদাকে আর বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতে সাহস করল না। তাই ভোরের জন্য অপেক্ষা না-করে তড়িঘড়ি রাত্রি বারোটার সময়ই তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা। শোনা গেল মিলিটারি বুটের শব্দ। তারা হানা দিল মাস্টারদার সেলে ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে টেনে আনার জন্য। কিন্তু, তাঁর তো আমরণ পণ, কিছুতেই বিনা দ্বন্দ্বে আত্মসমর্পণ করবেন না! তাই তারা মাস্টারদার সেলে ঢুকতেই তিনি 'বন্দে মাতরম' বলতে বলতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাদের ওপর। প্রথমটায় তারা হকচকিয়ে গেলেও, পরক্ষণেই মারমুখী হয়ে সবাই মিলে মাস্টারদাকে এলোপাতাড়ি মারতে লাগল। মাস্টারদা পড়ে গেলেন। এতগুলো মারমুখী হাত, এতগুলো বুট! তিনি পারলেন না। ঘুষি-লাথিতে ক্রমাগত মারতে মারতে তারা মাস্টারদার দু'পাটির দাঁত ভেঙে দিল, নাকের হাড় গুঁড়ো করে দিল। রক্তে ভেসে গেল তাঁর মুখ, ভেসে গেল তাঁর শরীর। তবু মার চলল ততক্ষণ, যতক্ষণ না তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন! কিন্তু, জ্ঞান হারিয়েও তিনি নিষ্কৃতি পেলেন না। তাঁর অচেতন দেহটা টানতে টানতে নিয়ে গেল ফাঁসির মঞ্চে, সেই অবস্থাতেই চরম আক্রোশে তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিল তারা। পৃথিবীর ইতিহাসে যা ঘটেনি, সেই ন্যক্কারজনক ঘটনাই তারা ঘটাল! ক্রূর লিভারের শব্দ আর শয়তানের পৈশাচিক উল্লাসে শেষ হয়ে গেল এক বিপ্লবীর জীবন! দেশবাসী এই মহান সংগ্রামীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগও পেলেন না। ফাঁসির মঞ্চ থেকেই তাঁর মৃতদেহ মেথরের হাত বেয়ে গায়েব করে দেওয়া হল, তার আর হদিশ পাওয়া গেল না। শুধু গুজবে শোনা গেল, বঙ্গোপসাগরে নাকি তাঁর মৃতদেহ ফেলে আসা হয়েছে, যাতে তিমিহাঙ্গরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়! আচ্ছা, তাতেও ইংরেজ আর ইংরেজের চামচাদের পৈশাচিক প্রবৃত্তি তৃপ্ত হয়েছিল কি?
শুধু যে পরাধীন দেশে ইংরেজের অবমাননার শিকার হয়েছেন সূর্য সেন, তাই নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ক্ষমতার ধামাধারীদের কাছেও হয়েছেন। এই মহান বিপ্লবীর প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাটুকু জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। বরং, ১৯৪৮ সালে মাস্টারদাকে নিয়ে একটি বাংলা সিনেমা তৈরির প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধা দিয়েছিল তারা। এমনকি এই সময় লেখক মনোরঞ্জন ঘোষ 'চট্টগ্রাম বিপ্লব'-নামের বই লিখে মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবীজীবনের প্রকৃত ইতিহাস জনসমক্ষে আনতে গিয়েও তাঁদের কাছে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বইটিকে সম্মুখীন হতে হয়েছিল কংগ্রেস সরকারের সেন্সরশিপের। সেই রাহুর দশা কাটতে সময় লেগেছিল আরো দু'দশক। রাষ্ট্র জানে বিপ্লবের প্রকৃত ইতিহাস প্রকাশ পেলে, তাদের নির্লজ্জ চাটুকারিতা আর লালসার পুঁজপচা ঘা জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়বে! তাই এখনও প্রকৃত ইতিহাস মুখ ঢেকে থাকে শিশুপাঠ্য কাহিনি হয়ে। শেষ ভাষণে স্বাধীন ভারতের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে একটা কথা সূর্য সেন বলছিলেন, যা আজকের প্রেক্ষাপটে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক :
'তোমাদের কাছে শুধু এক অন্তিম অনুরোধ রেখে যাই--দলাদলি করে দেশকে ডুবিও না। শাসকের নাগপাশ আমার কণ্ঠরোধ করলেও আমার এ কথা তোমরা মনে রেখো।-- বন্দে মাতরম!'