“লে লো বাবুজী, সুরাইয়া কে ক্ষেত কী হ্যায়”
সবজি বাজারে তাঁর নামে ফল পর্যন্ত বিক্রি করতে পারত দোকানিরা। তাঁর কণ্ঠের মতো মিষ্টি হবে ফল। এই গ্যারান্টি দিতেন তাঁরা। মানুষ কিনেও নিত, এমনই ছিল ‘ব্র্যান্ড সুরাইয়া’র প্রভাব।
পুরো নাম সুরাইয়া জামাল শেখ। দেশ তাঁকে চিনেছিল ‘সুরাইয়া’ নামে। গান আর অভিনয়ে দর্শকদের মনে করে নিয়েছিলেন সম্রাজ্ঞী আসন। খেতাব পেয়েছিলেন মালিকা-ই-তাবাসসুম। চল্লিশের দশক মাতাল ছিল তাঁর গান আর রূপে। গানের জন্য দুনিয়ার ‘দিল’ জিতে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর গানের জগতে আসা অনেকটা হঠাৎ করেই।
জন্ম লাহোরে গুজরানওয়ালাতে। ১৯৩০ সালে বোম্বাই চলে আসে পরিবার।ওঠেন কাকার বাড়িতে। বাবার একটা ছোট্ট আসবাবের দোকান ছিল।
কাকা চাকরি করতেন কার্দার ফিল্মসে। সেই সূত্রেই প্রথম ব্রেক পান শিশু সুরাইয়া। ১৯৩৬-এ ‘মাদাম ফ্যাশন’ ছবিতে। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে শিশু শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করলেন। বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদের আবিষ্কার তিনি। সুরাইয়াকে গাইতে দিলেন, ‘পনছি জা’...সবে বারো বছর বয়স, মাইকের নাগাল পেতেও বেশ কসরত করতে হয়, কিন্তু হিট করে গেল গান। ওই এক গানেই ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলেন সুরাইয়া।
চল্লিশের হিন্দি ছবির দুনিয়া ছিল দুই সম্রাজ্ঞীর দখলে। প্রথম জন নূরজাহান। দ্বিতীয় জন সুরাইয়া। মেহবুব খানের ছবি ‘আনমোল ঘড়ি’তে একসঙ্গে পর্দায় দেখা গিয়েছিল তাঁদের।
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তান চলে যান নূরজাহান। বোম্বাইয় ফিল্মিস্তানের একমাত্র রানী তখন সুরাইয়া। ১৯৪৬-১৯৫০ ২৫ ছবিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
সুরাইয়ার অভিনয় কেরিয়ারে বড় ব্রেকথ্রু কে এল সায়গলের সঙ্গে দেখা। জয়ন্ত দেশাইয়ের পরিচলনায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ ছবির শুটিং চলছে তখন। একদিন সেটে এলেন কে এল সায়গল। কানে এলো সুরাইয়ার রেওয়াজ। অভিভূত সায়গল দেশাইকে প্রস্তাব দিলেন তাঁর বিপরীতে সুরাইয়াকে কাস্ট করার জন্য। ছবির নাম ‘তদবীর’। সালটা ১৯৪৫। ছবিতে সায়গল গাইলেন ‘মিল নে কি দিন’। পর্দায় দেখা গেল পান পাতা মুখের সুন্দরী সুরাইয়াকে। সে দৃশ্য গেঁঠে গেল বহু হৃদয়ে। তাঁর বয়স তখন সবে ষোল।
সুরাইয়া আর সায়গলের কেমিস্ট্রিকে ভালোবেসে ফেলল দর্শক। আবার দেখা গেল এই জুটিকে। ‘ওমর খৈয়ম’ আর ‘পারওয়ান’ পরপর দুই ছবিতে।
‘ফুল’, ‘বৈদ্য’, ‘জিত’, ‘দাস্তান’, ‘সানম’, ‘আফসর’-এর দেখা গেল সুরাইয়া। ‘প্যার কি জিত’, ‘বড়ি বহেন’, ‘দিল্লাগী’ হিটের সংখ্যা কম নয়!
১৯৫৪-তে মুক্তি পেল সোহরাব মোদির ‘মির্জা গালিব’। দু-দুটো জাতীয় পুরস্কার পেলেন। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু সুরাইয়াকে ডেকে বলেন, ‘কবির কবিতা প্রাণ পেয়েছে তাঁর কণ্ঠে’। প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে সুরাইয়া হিন্দি গানের জগতে এক আলাদা অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন নিজেকে।
সুরাইয়া যেন মিথ হয়ে উঠছিলেন ক্রমশ। তিনি নিজেই জন্ম দিলেন আর এক মিথের। এই মিথ ভারতীয় প্রেমের ইতিহাসে রূপকথা হয়ে উঠেছিল বলে যায়। সুরাইয়া আর দেব আনন্দের।
সুরাইয়ার সঙ্গে দেব আনন্দের দেখা ১৯৪৮-এ। ‘বিদ্যা’ ছবির সেটে। প্রথম দর্শনেই সুরাইয়ার প্রেমে পড়ে যান দেব। সুরাইয়ের কিন্তু দেব নিয়ে আলাদা করে ভাবার মতো কোনও অনুভূতি আসেনি।
মাঝ নদীর এক দুর্ঘটনা বদলে দিল গোটা চিত্রনাট্য। গানের দৃশ্যের শুটিং চলছিল। নৌকাতে বসে সুরাইয়া। লিপ দিচ্ছেন ‘কিনারে কিনারে চলে জায়েঙ্গে’। আচমকাই উল্টে গেল নৌকা। নদীতে মালিকা-ই-তাবাসসুম। সেই সময় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তাঁর প্রাণ বাঁচান দেব।
সুরাইয়ার মনে হয়েছিল দ্বিতীয় জীবন পেলেন তিনি। মন ঘুরল দেবের প্রতি। প্রেমে পড়লেন দুজনেই। পরিবার থেকে বাধা এসেছিল প্রবল। ভিনধর্মে প্রেম-বিয়ে মানতে পারেনি সুরাইয়ার পরিবার। তার ওপর সুরাইয়ার আয়ের ওপর দাঁড়িয়ে পুরো সংসার। সেই মেয়ে বিয়ে-নিকা করলে পরিবারের কী হবে, সেই অনিশ্চয়তাও কম ছিল না সুরাইয়া সেই সময় ‘হায়েস্ট পেইড ফিমেল অ্যাকট্রেস’।
সব বাধার বিরুদ্ধে গিয়েও তাঁরা স্থির করেন বিয়ে করবেন। সুরাইয়ার বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায় সে খবর। আটকে যায় তাঁদের বিয়ে। আরও একবার দেব আনন্দ বিয়ের প্রস্তাব দেন তাঁকে। কিন্তু এবার রাজি হননি সুরাইয়া। সেখানেই ফুরিয়ে যায় দেব-সুরাইয়ার রূপকথা।
পরবর্তী সময়ে দেবের সঙ্গে তাঁর প্রেম নিয়ে সাক্ষাৎকারে মুখ খুলেছেন সুরাইয়া। তারকাসুলভ এড়িয়ে যাওয়া বা নীরবতা নয় দ্বিধাহীনভাবে ফিরে তাকিয়েছেন অতীতের দিকে।
সারাজীবন একাই থেকেছেন। স্মৃতি আগলে। সুরাইয়ার টানেই ‘গ্রেগরি পেগ’ হয়েছিলেন দেব। ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ২০০৪ সালে চোখের আড়ালে নীরবে বিদায় নেন চল্লিশের কোকিল।