গৃহের নাম, 'সুধর্মা'। গৃহকর্তার নাম, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। 'সুধর্মা' হল, দেবসভার নাম। গৃহটি দেবসভাই বটে। দেওয়ালে খোদাই করা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের বাণী। আলমারি জুড়ে, বিছানা জুড়ে রাশি রাশি বই। শোকেসে শোকেসে বিশ্বের আশ্চর্য সব কিউরিও। তারই মধ্যমণি জ্ঞানতাপস সুনীতিকুমার। চশমাচোখের জ্ঞানঋদ্ধ ব্যক্তিত্বে তাঁকে গম্ভীর বলে অনেকেই ভুল করতেন। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি যেমন রসিক মানুষ বলে খ্যাতনামা ছিলেন, তেমনি ছিলেন রসনা রসেও পটু। তিনি নিজে খেতে তো ভালোবাসতেনই, অন্যকেও খাওয়াতে ভালোবাসতেন। তাঁর এই গুণপনার গুণগান করে বন্ধু প্রমথনাথ বিশী একদা 'পুরাতন পঞ্জিকা' কবিতায় লিখেছিলেন :
"বিদ্যাভরপুর,
তবু কার ভাল লাগে ছোলা চানাচুর,
শাস্ত্র হতে এ জীবন বড় কাছে যাঁর
সুবিখ্যাত অধ্যাপক সুনীতিকুমার।"
প্রমথনাথ সুনীতিকুমারের 'চানাচুর' প্রীতির সাক্ষাৎ নিদর্শন পেয়েছিলেন ধর্মতলায় 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকার অফিস-আড্ডায়। সেই আড্ডার প্রমথনাথ ও সুনীতিকুমার ছিলেন নিয়মিত সদস্য। সুনীতিকুমারের পছন্দের একটি চানাচুরের দোকান ছিল ওয়েলিংটনে। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর ওই দোকানের সঙ্গে নৈমিত্তিক খরিদ্দারির সম্পর্ক। ঠাসা এক ঠোঙা চানাচুর নিয়ে তিনি আড্ডায় হাজির হতেন। খেতে খেতে জমে উঠত আড্ডা। সরস রসনা ও বাগ্মী রসিকতায় বিশ্ববিদ্যা ধরা দিত মোহময় হয়ে। মুগ্ধ করে ফেলত শ্রোতাদের। তারই মাঝে হাত ও মুখের কাজটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে ঠোঙাটি ফাঁকা করে ফেলতে একটুও সংকোচ করতেন না সুনীতিকুমার।
সে-বার এক সভায় রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুনীতিকুমার বললেন, "তাঁকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু যেদিন শুনলাম তিনি একটি গোটা পাঁঠা একাই ভোজন করতে পারতেন, সেদিন থেকে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।" আহার, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চায় তিনি ছিলেন রামমোহনের মতোই বিশ্বপথিক বিশ্বজনীন। বিজাতীয় শাস্ত্রে যেমন তাঁর রুচি ছিল, বিজাতীয় খাবারেও তেমনি তাঁর কোনরকম অরুচি ছিল না। আহারকে তিনি যে-কোন জাতি-সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। পাঁচের দশকে মিশরে গিয়েছিলেন তিনি। কায়রোয় কাজকর্ম সেরে ঠিক করলেন পুরনো কোন গ্রাম্য হোটেলে মাংস খেয়ে দেখবেন, দেখবেন এঁদের গ্রাম্য রান্নার কেমন স্বাদ। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সঙ্গী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তখন গ্রামীন লোকেরা ভারতীয়দের অসম্ভব ঘৃণা করত, পছন্দ করত পাকিস্তানিদের। সুনীতিকুমারকে চেহারা-পোশাকে ভারতীয় বলে সন্দেহ হল কয়েকজন স্থানীয় তে-এঁটে লোকের। তারা পথ আটকে ঘিরে ধরল তাঁদের। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল, বেচাল বুঝলেই মারমুখো হতে কার্পণ্য করবে না, এমনই তাদের হাবভাব। সুনীতিকুমার ও সঙ্গী দেখলেন ব্যাপারটা একেবারেই সুবিধের নয়। তবে, ভুবনচষা লোক সুনীতিকুমার খুব একটা ঘাবড়ালেন না। যে-কোন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশে যাবার অসাধারণ গুণ তাঁর সহজাত ছিল। সেই গুণেই তিনি লোকগুলোকে অল্পক্ষণেই হাত করে ফেললেন এবং তার ওপর বিশুদ্ধ উচ্চারণে কোরআনের বয়েত আউড়ে একেবারে মাত করে দিলেন। সুতরাং, জনজাত বাধা গেল ছুমন্তর দূর হয়ে। এবং, সে-দেশি মাংসের ঝোলে রসনা তৃপ্তিতেও আর কোন গোল রইল না।
বার্মা ভ্রমণকালে এক বর্মী বন্ধুর বাড়িতে ঘটেছিল আহার-ঘটিত এক সাংঘাতিক কাণ্ড। নিমন্ত্রিত হয়ে একদিন গেছেন সে বাড়িতে। তাঁকে খেতে দেওয়া হল ভাত। ভালো কথা। কিন্তু, তার সঙ্গে যে মাছের পদটি দেওয়া হল, সেটি সাংঘাতিক। অত্যন্ত দুর্গন্ধময় 'নাপ্পি'। গন্ধে আঁত উল্টে আসার জোগাড় হল, তবু মনকে শান্ত করতে করতে স্থিতধী হওয়ার চেষ্টা করলেন সুনীতিকুমার। আহারের অপমান করতে তিনি শেখেননি। এবারও করলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি মনটাকে স্থির করে প্রস্তুত করলেন। তারপর নাপ্পির সদ্ব্যবহার সহযোগে তৃপ্তির সঙ্গে অন্নগ্রহণ করলেন।
সুনীতিকুমারের পাণ্ডিত্যের গল্পের যেমন শেষ নেই, তেমনি শেষ নেই আহার-অ্যাডভেঞ্চারের গল্পকথারও। শেষ বয়সে সুনীতিকুমারের সুগার, ব্লাডপ্রেসার, কোলেস্টেরল প্রভৃতি সবই অল্পস্বল্প বেড়েছিল। সুতরাং, ডাক্তারের পরামর্শে খাওয়া-দাওয়া একেবারে নিয়মমতে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সুনীতিকুমারের পুত্রবধূ ছায়া চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, "উনি (সুনীতিকুমারের পুত্র) হয়ত কোনবার রিপোর্টে ডায়াবিটিস কমেছে দেখে খুশী হয়ে বললেন, "মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে কত তাড়াতাড়ি তোমার সুগার কমে গেল দেখছ তো বাবা।" বাবা মিটিমিটি হাসলেন। পরে বললেন, "লুকিয়ে কিনে একটু-আধটু মিষ্টি আমি রোজই খেয়েছি। তাতে কিছুই ক্ষতি হয় নি, দেখলে তো বাবু।" এই হচ্ছেন খাদ্যরসিক সুনীতিকুমার। শ্রদ্ধেয় গোপাল হালদার তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, 'gourmet' (অতিভোজী) ও 'gourmand' (ভোজন-বিলাসী); এবং তাঁর সেই সম্বোধন ছিল একান্তই যথার্থ।
তথ্যঋণ: 'সমসাময়িক দৃষ্টিতে সুনীতিকুমার'- পল্লব মিত্র সম্পাদিত।