সুমিতা সান্যাল: এক অবহেলিত প্রতিভা

মেয়েটির আসল নাম মঞ্জুলা...মঞ্জুলা সান্যাল। ১৯৪৫ এর ৯ই অক্টোবর জন্ম দার্জিলিঙে। পনেরো বছর বয়সে প্রথম সিনেমায় অভিনয়। আগাগোড়া ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এই মেয়েটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সখ্য ছিল তখনকার নামকরা নায়িকা লীলা দেশাইয়ের। তিনিই মঞ্জুলার পরিচয় করিয়ে দেন পরিচালক বিভূতি লাহার সঙ্গে। বিভূতি বাবু বললেন "তোমার এই মঞ্জুলা নাম সিনেমায় চলবে না"। মেয়ের নাম পাল্টে রাখা হলো সুচরিতা। প্রথম ছবিতেই ছক্কা হাঁকালেন। ১৯৬০ এ "খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন"। সহ-অভিনেতা মহানায়ক উত্তম কুমার। এই নাম আবার পাল্টে গেল। পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায় "সুচরিতা" নাম পাল্টে রাখলেন সুমিতা। এই সুমিতা সান্যাল নামেই বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি।

স্টেশনের নাম নিঝুমগড়। নিশুতি রাতে সেই স্টেশনে নামছেন এক তরুণী। একটি বাচ্চা মেয়ের গভর্নেসের চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন এমন এক বাড়িতে যে বাড়িতে যেতেন সকলে ভয় পায়। মনে পড়ে তরুণ মজুমদার পরিচালিত "কুহেলি" ছবির কথা? অথবা ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত আনন্দ ছবির সেই দৃশ্য, যেখানে মৃত্যুশয্যায় এক তরুণ বলছে "বাবুমশাই নেহি আয়া?" তার মাথায় হাত বুলিয়ে এক তরুণীর উত্তর, "আভি আ যায়েঙ্গে",
কিংবা সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি "নায়ক" -এর সেই রহস্যময়ী মেয়েটিকে, বাংলা ছবির এক নম্বর নায়কের কাছে পার্ট চাইতে এসে হঠাৎ কেঁদে ফেলে, তার পরমুহূর্তে হেসে উঠে চোখের জল আঙুলে নিয়ে বলে "গ্লিসারিন লাগবে না"...

উল্লিখিত এই চরিত্রগুলোর তিনটিতেই অভিনয় করেছেন সুমিতা সান্যাল। তপন সিংহের "সাগিনা মাহাতো" ছবিতে দিলীপ কুমারের সহঅভিনেত্রী ছিলেন সুমিতা সান্যাল। সেই সময়কার সমস্ত বিখ্যাত চিত্রপরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। এবং প্রত্যেকটি চরিত্রে তিনি উজ্জ্বল। হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুমিতা সান্যাল। "আনন্দ"-এ তিনি অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। হৃষিকেশ মুখার্জির "গুড্ডি" ছবিতেও জয়া ভাদুড়ীর বৌদির চরিত্রে তাঁর অভিনয় আলাদা ভাবে নজর কাড়ে। "দেয়া নেয়া" ছবিতে তনুজার বান্ধবী অথবা "আপনজন" সিনেমার ধুরন্ধর বৌদি - প্রত্যেক চরিত্রে তিনি স্বকীয়তার ছাপ রেখেছিলেন। বাংলা হিন্দি মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। অন্যান্য বাংলা ছবির মধ্যে রয়েছে "আকাশ প্রদীপ", "গোধূলি বেলা", "অনুষ্টুপ ছন্দ", "স্বর্গ হতে বিদায়", "নতুন জীবন", "হারানো প্রেম", "হঠাৎ দেখা" এবং আরো অনেক হিন্দি ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য "আশীর্বাদ", "মেরে অপনে", ইত্যাদি। তাঁর লিপে লতা মঙ্গেশকারের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান "না জিয়া লাগে না" আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তবে শুধু বড় পর্দা নয়, ছোট পর্দা এবং থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সেখানেও তাঁর চরিত্রে রেখেছেন আভিজাত্য এবং প্রতিভার স্বাক্ষর। এক সময়ের জনপ্রিয় এবং প্রতিভাময়ী এই অভিনেত্রী এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চের মায়া কাটিয়ে অন্যলোকে যাত্রা করেন ৯ই জুলাই ২০১৭ -এ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...