গানের পালা সাঙ্গ মোর

মনসূয়া গ্রামে জমিদারি দেখতে গিয়ে ফিরে এলেন জ্বর নিয়ে। সে জ্বর কিছুতেই কমে না। ক্রমশ কাবু করে বিছানায় বন্দি করে ফেলল একপ্রকার।

লীলা মজুমদারের লিখেছেন –“শুনলাম রোগের নাম কালাজ্বর। তার তখন কোন ভাল চিকিৎসা ছিল না। চোখের সামনে একটু একটু করে বড়দার শরীর ভাঙতে লাগল। ...। তার আগের বছরেই বড় বৌঠানের একটি সুন্দর ছেলে হয়েছিল, ঘটা করে তার নামকরণ হয়েছিল ... ছেলের নাম সত্যজিৎ। ডাক নাম মানিক।

লীলা মজুমদারের বড় দাদা। শিশু সত্যজিতের পিতা। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তাঁর অকাল প্রয়াণ।

তিনি সুকুমার রায়। পুরো নাম সুকুমার রায় চৌধুরী। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র। ডাক নাম ছিল 'তাতা'। আদরের 'তাতাবাবু'। রবীন্দ্রনাথের 'রাজর্ষি' উপন্যাস থেকে উপেন্দ্রকিশোর গ্রহণ করেছিলেন নামটি। মেয়ে 'হাসি', আর ছেলে 'তাতা'।

এক প্রবল কর্মশালী পুরুষ। বহুধা বিস্তৃত জীবন। অফুরন্ত ছন্দের জমজমাট বেঁচে থাকা। কিন্তু দিন ফুরনের আমন্ত্রণ যেদিন এলো সেই ডাক কে শান্ত চিত্তে গ্রহণ করলেন। কালজ্বরের কোনও ওষুধ নেই। প্রাণ চঞ্চল মানুষটি ক্রমশ বিছানায়। তবু অদম্য প্রাণ শক্তির জোর। অসুখের দিনগুলোতেও ছাপা, লেখা নিয়ে ভাবনা থেমে নেই। শারীরিক কষ্টের কাছে নতি স্বীকার করেন নি।

 

সুকুমারের অসুস্থতার খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ এসে মৃত্যুপথযাত্রী তার যুবক বন্ধু’কে দেখে যেতেন। বন্ধুর অনুরোধে গান শোনাতেন। কবির কন্ঠে কবির গান। শাশ্বত মৃত্যুর অন্তরে সত্য সুন্দরের উপলব্ধি। অনিবার্যতাকে সহজ চিত্তে গ্রহণের বোধ। আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’, ‘দুঃখ এ নয় সুখ নহে গো গভীর শান্তি এ যে’ এমন সব গান শুনতে চাইতেন সুকুমার। এ প্রসঙ্গে সুকুমারের সহোদরা মাধুরীলতা বলেছেন –“গানের পর গান চলিল, সকলে তন্ময় হইয়া গান শুনিতে লাগিলেন।দাদার প্রশান্ত মুখখানি দেখিয়া মনে হইতেছিল যে তিনি পরম শান্তি লাভ করিয়াছেন।”

 

ভুগলেন টানা আড়াই বছর।

 

১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ১০০নং গড়পার রোডের বাড়িতে বিদায় নিলেন সুকুমার।

 

লীলা মজুমদারের লেখনীতে বড় বেদনায় উঠে এসেছে সেদিনটা–“... কত ইচ্ছা, কত আশা। ... মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বড়দা তার সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। ... জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিগত শোকের আঘাত বুঝলাম।”

 

 

সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর কবিগুরু শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় আচার্যের আসনে ছিলেন তিনি স্বয়ং। তিনি বলেন –“আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার মনে হয়েছে, জীব-লোকের ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মলোক আছে। যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন, অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সে গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”

 

লেখায়, রেখায়, ছন্দের মজলিশে তিনি বাঙালির উত্তর খোলা জানলা। একমেবাদ্বিতীয়মপ্রজন্মের পর প্রজন্ম কে বুঁদ করে রেখেছেন আবোল তাবোলের নেশায়। ক্ষণে ক্ষণে চমক জাগিয়েছেন। তাই আবোল তাবোল এর শেষ ছড়ায় লেখা তাঁর লাইনগুলো আমাদের কাছে অমোঘ মনে হয়। যেন নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই লিপিমালায় বন্ধ করে যাচ্ছেন সুকুমার।

 

'আদিম কালের চাঁদিম হিম,

তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,

গানের পালা সাঙ্গ মোর।'

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...