সুখেন দাসঃ যে-জীবন সিনেমার মতো

বউবাজারের বিখ্যাত গলি, ‘শ্রীনাথ দাস লেন’। এই শ্রীনাথই হলেন অভিনেতা-পরিচালক-চিত্রনাট্যকার সুখেন দাসের পূর্বপুরুষ। পিতামহ।

শ্রীনাথ ছিলেন উনিশ শতকের কলকাতার বিখ্যাত অভিজাতদের মধ্যে অন্যতম। অথচ এমন এক ঐতিহ্যবাহী বনেদি বাড়ির ছেলে হয়েও সুখেন দাসকে ছেলেবেলায় অনাথ আশ্রমে থাকতে হয়েছে, অন্নের আশায়, কাজের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। কেন? সে-কথাই আজ বলবঃ  

আসলে শ্রীনাথদের আদি বাড়ি ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার হালিশহরে। সেখানে ধনী হিসেবে তাঁর পিতা রামলোচন দাসের যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। রামলোচনই উনিশ শতকের প্রথমদিকের কোন এক সময় সেখান থেকে উঠে এসে কলকাতার বউবাজারে দুর্গাদালানসহ দারুণ অট্টালিকা নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেন। হালের দশ নম্বর শ্রীনাথ দাস লেনে এখনও সেই দুর্গাদালানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এবং আজও ফি-বছর সেখানে বেশ ধুমধাম করে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়।

যাই হোক, শ্রীনাথ নিজে সেই সময় ওকালতিতে দারুণ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং কলকাতার বুকে সম্পত্তি বাড়িয়ে পিতার বনেদিয়ানা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর পুত্রদের বেলায় হল অন্যথা। তাঁদের মধ্যে দু’জন বাংলা নাট্য-আন্দোলনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, সর্বস্ব পণ করতেও তাঁদের বাধেনি। এঁদেরই মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত নাট্যকার-নাট্যপরিচালক-মঞ্চাধ্যক্ষ উপেন্দ্রনাথ দাস।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি ‘শরৎ সরোজিনী’ ও ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ নামের ব্রিটিশবিরোধী নাটক লিখে বাংলা নাট্যজগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক হিসেবে রাজরোষে কিছুদিনের জন্য কারাবরণ করেছিলেন। সমাজ সংস্কারে মন দিয়ে বিদ্যাসাগরের আহ্বানে বিধবা বিবাহ করেছিলেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল, সৃষ্টিশীল ও অকুতোভয়।

শ্রীনাথের আরেক পুত্র ফণীন্দ্রনাথ দাস। ইনিই হলেন সুখেন দাসের পিতা। নাট্য-উৎসাহী ফনীন্দ্রনাথ যুক্ত হন নাট্য-প্রযোজনার সঙ্গে। একের পর এক লোকসানে তিনি এক সময় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। এবং দেনার দায়ে একই দিনে কলকাতার বুকে তাঁর অংশের ন’টি বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় রাতারাতি তাঁর মাথার ওপর থেকে ছাদটুক যেমন সরে যায়, পায়ের নীচের মাটিও তেমনি আর অবশিষ্ট থাকেনি। বিপর্যয়ের এই ধাক্কা ফণীন্দ্রনাথ সামলাতে পারেননি। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর স্ত্রীও শোক সামলাতে না-পেরে তাঁর মৃত্যুর খানিক পরেই মারা যান।

দুর্ঘটনাটা যে-সময়কালে ঘটে, সেই সময় সুখেন দাসেরা পাঁচ ভাইবোন বয়সে নেহাতই বালক-বালিকা। তবু তাঁরা শোকযাপনের অবসরটুকও পাননি। রাতারাতি অনাথ ও নিরাশ্রয় হয়ে স্বজনের সৌজন্যে তাঁদের ঠাঁই হয়েছিল এক অনাথ আশ্রমে।

কিন্তু আর-সকলে পারলেও অনাথ আশ্রমের চৌহদ্দি ডানপিঠে সুখেনকে ধরে রাখতে পারেনি। আসলে, নিজের প্রতি অগাধ আত্মবিশ্বাস, লড়ে বাঁচার সাহস আর বৃহতের টান ছিল সুখেনের অন্তরে। সেই টানেই লুকিয়ে একদিন সুযোগ বুঝে সুখেন পালিয়ে এলেন অনাথ আশ্রমের নজরদারি এড়িয়ে, বেড়া পেরিয়ে।

মাথার ওপর থেকে পড়ে-পাওয়া ছাদ গেল, চারপাশের দেওয়ালও গেল হারিয়ে। রাস্তা হল আশ্রয়। অন্যের উদারতা আর ছোটখাটো পরিশ্রমের বিনিময় হল ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায়। ধর্মতলার ফুটপাথে এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা দিন।

তারপর একদিন পাকেচক্রে আলাপ হল এক ডাক্তারের সঙ্গে। সুশ্রী গোলগাল চেহারার মায়াময় মুখের সুখেনকে দেখে তাঁর ভারি মায়া হল। কথা বলেও বেশ ভালো লাগল। একটা হিল্লে করে দেবার উদ্দেশ্যে সুখেনকে তিনি নিজের চেম্বারে নিয়ে এলেন। লাগিয়ে দিলেন ডিসপেনসারি পরিষ্কার থেকে শুরু করে ফাইফরমাশের কাজে। আহার-বিহারের আর অভাব রইল না। কাজেই ভালোমানুষ ডাক্তারবাবুটির এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে সুখেনের দিনগুলো বেশ নির্বিঘ্নেই কাটতে লাগল।

তাই বলে ছটফটে স্বভাবের সুখেন কিন্তু নির্বিঘ্নে বসে রইলেন না। অবসরে পড়াশুনো করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে লাগলেন। আর হলে হলে সিনেমা দেখে অবসর বিনোদন করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য সিনেমা আর অবসরের বিনোদন রইল না তাঁর কাছে। অভিনয়-নাটকের প্রতি বাবা-জ্যেঠার যে ভালোবাসা ছিল, তা তাঁর মধ্য থেকেও বিচ্ছুরিত হতে দেখা গেল উত্তরাধিকারসূত্রে। ভালোবাসা থেকেই ধীরে ধীরে সিনেমায় অভিনয়ের ঝোঁক তৈরি হল। শুরু করলেন, দেখা অভিনয়কে নকল করে পুনরাভিনয় করতে। দেখলেন, বাহ, এই তো বেশ ভালোই পারা যাচ্ছে! তাহলে!

তাহলে আর কী, শুরু হল সুযোগ পাওয়ার আশায় স্টুডিওয় স্টুডিওয় ঘোরাঘুরি। কিন্তু ঘোরাঘুরিই সার। সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা, স্টুডিওর ভেতর সহজে দারোয়ান ঢুকতেই দেয়না কিছুতে! ডানপিঠে সুখেনের এই বাধার পঞ্জিকা সহ্য হল না। একদিন গেটে বাধালেন দারুণ হট্টগোল। তাতে দারোয়ান আরও বেঁকে বসল। অমন বেপরোয়া ছেলেকে সেই-বা কেমন করে ঢুকতে দেয়! সুখেনও ছাড়বার পাত্র নন সহজে। ফলে হট্টগোল জমে উঠল।

জমাটি সেই হট্টগোলের মধ্যে বিখ্যাত শব্দযন্ত্রী জে. ডি ইরানি স্টুডিওতে ঢুকছিলেন। সুখেনের জেদ আর তাঁর মায়াময় মুখ দেখে তিনিও বিগলিত হলেন। নিজের দায়িত্বে তাঁকে ফ্লোরে নিয়ে এলেন। তারপর কথায় কথায় যখন শুনলেন যে, সুখেন অভিনয় করতে চান; তখন কিছু একটা করে দেখাতে বললেন। আদেশ পেয়ে সুখেন তৎক্ষণাৎ ভারি সুন্দরভাবে নানান জনের অভিনয়ের নকল ও কেরিকেচার করে দেখাতে শুরু করলেন। তাতে উপস্থিত সকলেই বেশ মজা পেলেন। মুগ্ধ হলেন।

ইরানিসাহেবের সঙ্গে ভেতরে ঢুকে সুখেন তখনই কোন কাজের সুযোগ পেলেন না ঠিকই, তবে স্টুডিওয় ঢোকার ছাড়পত্র পেয়ে গেলেন। কলাকুশলীদের অনেকের সঙ্গে সখ্যতাও তৈরি হয়ে গেল। কেউ কেরিকাচার করে দেখাতে বললে সুখেন যেন সর্বদাই প্রস্তুত। এমনি করে মনোরঞ্জন করতে করতে প্রায় সকলের সঙ্গেই ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ল। জুটতে লাগল স্টুডিওতে টুকটাক প্রোডাকশন বয়ের কাজ আর বড় বড় স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাজ দেখার সুযোগ। সে-সবের মধ্য দিয়েই সুখেন নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন।

স্টুডিওর কাজের ফাঁকে একদিন কিছু কলাকুশলীকে কেরিকেচার করে আনন্দ দিচ্ছিলেন সুখেন। সেটাই চোখে পড়ল প্রখ্যাত নাট্যকার ও সিনেমা পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্তের। বুঝলেন, সুখেনের মধ্যে প্রতিভা আছে। দূরদর্শী অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে এও বুঝলেন যে, সেই প্রতিভার আলো সুযোগ ও শিক্ষা পেলে অসামান্য দীপ্তিতে বিচ্ছুরিত হবে।

এ-সব ঘটনা যখন ঘটছে, সেটা ১৯৪৯ সাল। দেবনারায়ণ তখন ‘দাসীপুত্র’ নামে একটা ছবি করছেন। সুখেনের বয়স তখন মাত্র এগারো। সদ্য কেরিকেচার দেখে সুখেনমুগ্ধ দেবনারায়ণ তাঁকে এই ছবিতেই ছোট্ট একটি পার্ট দিলেন। ‘মাস্টার সুখেন’ হিসেবে এভাবেই এই ছবিতেই বাংলার সিনেমা জগতে অভিনেতা সুখেন দাসের আবির্ভাব ঘটে গেল।

এ-বছরই তিনি আরেকটি ছবিতে অভিনয় করেন, তা হল কবি-সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র পরিচালিত ‘কুয়াশা’ ছবিতে। এই ছবিতে তিনি ছোট্ট-নায়ক।

তারপর আরও পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করে প্রায় আড়াইশো বাংলা ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন। পঞ্চাশের বেশি ছবিতে নায়কের চরিত্রে এবং দুই শতাধিক ছবিতে তিনি চরিত্রাভিনেতা হিসেবে রেখেছেন নিজস্বতার স্বাক্ষর।

শুধু অভিনয় নয় কাহিনিকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা ও চিত্রপরিচালকের ভূমিকাতেও তিনি অত্যন্ত সফল। সত্তর পরবর্তী পরিবর্তিত কাহিনিধারার বাংলা ছবিতে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ‘সুখেন দাস’ একটি ঘরানার নাম। যে-ঘরানায় পারিবারিক মূল্যবোধের কাহিনি সপরিবারে দেখার মতো করে মেলোড্রামার মোড়কে বাণিজ্যিক আধারে পরিবেশনই ছিল শেষ কথা। তাঁর এই পথ বেয়েই তিনি কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর ‘পান্না হীরে চুনী’, ‘সিংহ দুয়ার’, ‘সোনা বৌদি’, ‘জীবন মরণ’, ‘দাদামণি’, ‘স্বর্ণমহল’ ‘প্রতিশোধ’ প্রভৃতি ছায়াছবি সেই সাফল্যের সাক্ষ্য দেয় আজও।

আসলে সুখেন দাস, অত্যন্ত কষ্টের জীবন থেকে তুচ্ছ কাজের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। শুন্য থেকে যেখানে সংগ্রাম শুরু হয়ে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে, সেখানে ‘সুখেন দাস’ একটি প্রেরণার নাম। নিজের আহার-আশ্রয়ের কষ্ট ও সংগ্রামের দিনগুলো তিনি কখনই ভুলতে পারেননি, তাই তাঁর শ্যুটিং ইউনিটে প্রত্যেকের খাওয়ার খোঁজ তিনি নিজে রাখতেন এবং নিজে সকলের শেষে খেতেন। এই ধারাটি তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন। 

আটের দশকে উত্তমকুমারের মৃত্যু এবং তার আগে থেকেই বাংলা সিনেমার ধারা পরিবর্তনের যুগসন্ধিতে একটা টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সেই দুঃসময়ে হাল ধরে বাংলা সিনেমা ও তার কর্মসংস্থানের জায়গাটিকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব অঞ্জন চৌধুরীর পাশাপাশি সুখেন দাসও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এটা করতে গিয়ে বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের শরিক হয়েও তিনি বাণিজ্যিক সিনেমার স্রোতে পাল তুলেছিলেন; পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে, বাংলা সিনেমাকর্মীদের টিকিয়ে রাখতে সেই সময় এছাড়া উপায়ও ছিল না। তবে চলচ্চিত্রে শালীনতা বা রুচির যে শিক্ষা স্বর্ণযুগ থেকে তিনি আহরণ করেছিলেন, তা নিজের সৃষ্টিতে নিছক বাণিজ্যের জন্য ব্যাহত হতে দেননি। বাংলা সিনেমার ইতিহাস তাই শুধু তাঁর অভিনয়জীবনের অবদান নয়, চিরকাল মনে রাখবে বাংলা সিনেমার নিরবচ্ছিন্ন পরিচ্ছন্ন প্রবাহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাঁর অবদানও…

 

তথ্যঋণঃ

‘সোনার দাগ’- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ

‘এই সময়’ পত্রিকা - ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...