রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর আকর। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে জীবন। সেভাবেই জীবনে এসেছে মাটির টান। সহজিয়া জীবনের খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক আখড়া থেকে আর এক আখড়ায়।
রাঙামাটির গান, আখড়াই জীবন উঠে এসেছে কলমে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক বাউল সংস্কৃতিকে অন্য চোখে চিনতে শিখেছিল সুধীর চক্রবর্তীর কলম দিয়ে। সম্প্রতি চলে গেলেন।
প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর ঠিক এক মাসের মাথায়। বন্ধুর নাম ‘পুলু’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৫ ডিসেম্বর বন্ধুর দেশে পাড়ি দিলেন সুধীরও। বন্ধু ১৫ নভেম্বর।
দুজনের মধ্যে গোড়া থেকেই মিল অনেক। দুজনেই ‘কৃষ্ণনাগরিক’। দুজনের জীবনের সঙ্গেই জুড়ে আছে জেলা হাওড়া। সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি যাওয়াও বন্ধু সৌমিত্রর সঙ্গেই। গানে, কবিতায় সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান তো ছিলই।
সুধীর চক্রবর্তীর ছোটবেলা কেটেছিল হাওড়ার শিবপুরে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানী বোমার ভয়ে সপরিবারে বাবার সঙ্গে চলে আসেন পৈত্রিক ভিটে দিগনগরে।
কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকার সুযোগ হয়নি। পড়াশোনার সুবিধার জন্য সকলে মিলে ফের চলে আসেন কৃষ্ণনগরে। সেই থেকে তাঁরা কৃষ্ণনাগরিক। নিজেকে সেভাবেই পরিচয় দিতেন।
বড় হয়ে ওঠা যৌথ পরিবারে। পাড়া-পড়শি নিয়ে মিলেজুলে বেঁচে থাকা। খুলে গিয়েছিল জীবনের জানলা দরজাগুলো। যত মানুষ, তত গল্প। গল্পের টানে কোথাও যেন মিশে গিয়েছিল উদাস বাউল সুর। অবতল মানুষদের সান্নিধ্য ছেনে তুলে এনেছিলেন সমাজ-লোক সংস্কৃতির রত্নসম্ভার। গত তিন দশক ধরে এক মনে করে চলেছিলেন সেই কাজ।
মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে স্নাতক হন। নিজে জাত শিক্ষক। গভর্মেন্ট কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতার 'ইনস্টিটিউট অফ ডেভলেপমেন্ট স্টাডিজে'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপনার আর মেধাচর্চা এই দিয়েই ঘেরা জীবন। আর ছিল কলম সহচর। সহজ কথায় অতল জীবনের আহ্বান। গভীর আর নির্জন তার পথ। আউলিয়া টানে যে বারবার উতলা হয়। সুর খোঁজে। সঙ্গী খোঁজে। ধরা দেয় না।
আশিটির বেশি বই লিখেছেন। বাংলার লোক সংস্কৃতি এবং বাংলা গান নিয়ে তাঁর গ্রন্থ গবেষকদের সহায়ক গ্রন্থ। 'বাউল ফকির কথা'র জন্য ২০০৪ সালে পান সাহিত্য আকাদেমি সম্মান।
‘ধ্রুবপদ’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। অগাধ পান্ডিত্যে কাছে টেনে নিতেন নতুনদেরও। যুক্ত ছিলেন আকাশবাণীর সঙ্গেও। তাঁর চলে যাওয়া সংস্কৃতির জগতে এক মহীরুহ পতন।