বয়েজ কাট চুল। মোটা ফ্রেমের চশমা। টানটান কণ্ঠ। ঋজু গলায় তিনি যখন গাইতেন ‘ও আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ মনে হয় বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উঠে আসছে সেই গান। কোথাও কোনও কাঁটাতার নেই, দুই-বাংলা মিলেমিশে একাকার। শিরায় শিরায় চঞ্চল হয়ে ওঠে রক্ত। তিনি সুচিত্রা মিত্র।
বাবা সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় জন্মের পর নাম রেখেছিলেন নন্দিনী। রক্তকরবীর নন্দিনী। শেষ পর্যন্ত সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়। বিবাহসূত্রে ‘সুচিত্রা মিত্র’।
ঝাড়খন্ডের ডিহিরি জংশনের গুঝাণ্টি স্টেশনে। ট্রেনের কামরার মধ্যে জন্ম। সালটা ১৯২৪। বাবা মায়ের চতুর্থ সন্তান। প্রি-ম্যাচিওর বেবি। গুঝাণ্টি স্টেশনে রেলের কামরায় জন্মেছিলেন বলে ডাক নাম হয়ে গেল ‘গজু’।
বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল কবিগুরুর। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখার সুযোগ পাননি সুচিত্রা। কবিগুরু গত হওয়ার ঠিক কুড়ি দিনের মাথায় তিনি পৌঁছলেন শান্তিনিকেতন। বৃত্তি পেয়েছিলেন।
অবশ্য গান শেখার শুরুটা কলকাতায়। বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। অমিতা সেন আর অনাদি কুমার দস্তিদারের কাছে। আর ফি রবিবার রেডিয়োতে পঙ্কজ মল্লিকের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার আসর।
শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়কে। শান্তিনিকেতনে তিনি নানা বাদ্যযন্ত্র শিখেছিলেন সেতার, এস্রাজ, তবলা। শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য কণ্ঠসংগীতই বেছে নিয়েছিলেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন নীলিমা সেনকে। প্রিয় বন্ধু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর ঝরঝরে, ঋজু কণ্ঠের গান মহিলা শিল্পীদের গায়কী সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাটাই বদলে দিয়েছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর গানের ভক্ত। একবার বলেছিলেন, ‘সুচিত্রার কন্ঠে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’ শুনে আমি একলা চলার প্রেরণা পাই’।
সুচিত্রা সেন আর ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল এই গল্প থেকে আন্দাজ করতে পারবেন পাঠকরা।
একবার ‘রবিতীর্থ’র ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার কথা তাঁর। সেই সময় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সফর হিসেবে রাজ্য সরকার তাঁদের যাতায়াতের সমস্ত খরচ বহন করবে। কিন্তু রাতারাতি পরিস্থিতি গেল বদলে। দেশে জারি জরুরি অবস্থা। সব কিছুতেই বেশ ডামাডোল। রাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও সেই স্রোতে ভেসে গেল। চরম সমস্যায় পড়লেন। আমেরিকা সফর কার্যত অনিশ্চিত। শেষ মুহূর্তে কীভাবে হবে টাকার জোগাড়?
পরিস্থিতির কথা জানতে পেরে পাশে দাঁড়াতে চাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
তাঁর মুম্বইয়ের বাড়ি বন্ধক রেখে আপাতত তিনি টাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন তিনি।
তবে তিনি সুচিত্রা মিত্র। আজন্ম সংগ্রামে বিশ্বাসী প্রবল ঋজু এক মানুষ।
তাঁকে বিনীতভাবে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, তিনি নিজেই যেভাবে হোক পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। নিজের যা গয়না ছিল সেস ব নিয়ে গেলেন ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্ক কর্তাদের সাহায্যে টাকার ব্যবস্থা হল। আমেরিকা যাওয়ার টিকিট হাতে বাড়ি ফিরলেন।
বিষয়টি কানে গিয়েছিল মিসেস গান্ধী’র। আমেরিকা সফর সেরে দেশে ফিরেছেন সুচিত্রা। কিছুদিন পর ভারত সরকারের সিলমোহর লাগানো একটি খাম পেলেন। ভিতরে একটি চেক। যাতায়াতের খরচ বাবদ পুরো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রবীন্দ্রনাথের একলা চলো রে গান তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল। শুধু মাত্র সঙ্গীত শিল্পী এই পরিচয়ে আটকে ছিলেন না। প্রতিবাদ আর বিপ্লব দুই শব্দকেই জীবনে ধারণ করেছিলেন।
আকাশবাণী তাঁকে ‘ব্যান’ করে।‘ বাল্মিকী প্রতিভা’য় জওহরলাল নেহেরুকে কটাক্ষ করে গান গাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। দীর্ঘ ৬ বছর আকাশবাণীতে তাঁর কোনও গান বাজেনি।
তাঁকে কটাক্ষ করার অভিযোগে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হলেও জওহরলাল নেহেরু কিন্তু ভালোবেসেছিলেন তাঁর গান।
দীর্ঘদিন তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। গণসঙ্গীত গেয়েছেন। গেয়েছিলেন সলিল চৌধুরীর গান। সাড়ে চারশোর বেশি রবীন্দ্রগানের রেকর্ড বেরিয়েছে তাঁর।
তবে শুধু মাত্র গানের পারে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। সিনেমায়, নাটকে অভিনয় করেছেন। পরে মৃনাল সেনের পদাতিক ও ঋতুপর্ণ ঘোষের দহন ছবিতে অভিনয় করেছেন। খলিল জিব্রানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। কবিতা গল্প লিখেছেন। নিয়মিত ছবি আঁকতেন। পুতুল তৈরি করতেন।
রবীন্দ্রনাথ আক্ষরিক অর্থেই তাঁর জীবন দেবতা ছিল। নিজের আত্মজীবনী ‘মনে রেখ’তে লিখেছিলেন, বহমান জীবনে দুঃখ, আঘাত, যন্ত্রণা সহ্য করতে তাঁকে শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গোটা জীবন রবির আলোর সুরেই বাঁধা থেকেছে।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেনঃ
“ আকাশ যখন চক্ষু বোজে
অন্ধকারের শোকে
তখন যেমন সবাই খোঁজে
সুচিত্রা মিত্রকে,
তেমন আবার কাটলে আঁধার
সুর্য্য উঠলে ফের
আমরা সবাই খোঁজ করি কার?
সুচিত্রা মিত্রের।
তাঁরই গানের জোৎস্নাজলে
ভাসাই জীবনখানি
তাইতো তাকে শিল্পী বলে
বন্ধু বলে জানি। ”