মাঠভরা কাশ ফুল। দূর দিয়ে ভেসে আসছে রেলগাড়ি। হাওয়ায় দুলছে ফুলগুলো। আর তার মাঝ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুই ভাইবোন। রেলগাড়ি দেখতে তাদের দৌড়।
বাঁশ বাগানে পাতার ঝিলমিল। আয়নায় কিশোরী কন্যার মুখ। ডাগর চোখে কাজল টানে মধ্যমায়। চুল ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি ভেজে। মুখ ভিজে যায় জলের ধারায়।
ক্যামেরার লেন্সে কাব্য সাজিয়েছিলেন তিনি। এক কবি যদি সত্যজিৎ হন, আর একজন কবি অবশ্যই তিনি। আলো-ছায়া-কবিতায় কাঁদিয়ে ছিলেন বাঙালিকে। শুধু বাঙালি কেন, গোটা পৃথিবীর সিনেমাপ্রেমিকে।
চলন্ত ট্রেনে এক অরিন্দম। চোখ আটকে খবরের কাগজে। সিগারেটের ধোঁয়া রিং হয়ে উড়ে যায় হাওয়ায়।
হাওয়ায় ওড়ে টাকা। উড়তে উড়তে মাটি ছুঁয়ে নোটের পাহাড়। উড়ন্ত নোট নিয়ে বালি-খেলায় মাতে অরিন্দম। তারপর ডুবে যায় চোরা-বালির ফাঁদে। চিৎকার করে ওঠে সে।
শিউরে ওঠে দর্শক। পর্দার ধূসরতা গ্রাস করে তাদেরও।
নেপথ্যে থেকে যায় মানুষটি। সুব্রত মিত্র। পৃথিবীর সেরা পাঁচ সিনেমাটোগ্রাফারের মধ্যে তিনি এক নাম।
আলোর খোঁজ করতেন তিনি। অন্ধকারেরও। ক্যামেরার লেন্সে আলো আধাঁরির খেলা তাঁর প্রিয় বিষয়।
পথের পাঁচালি, অপুর সংসার, অপরাজিত, চারুলতা, জলসাঘর, দেবী, নায়ক প্রতি ছবিতেই নতুন-নতুন ফ্রেম। নতুন-নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
ঘন্টার পর ঘন্টা পরীক্ষা চালাতেন একটা ফ্রেমকে মনের মতো করে তোলার জন্য। পাগল ছিলেন ‘পারফেকশনে’র জন্য!
কলেজে পড়তে পড়তেই ঠিক করে নিয়েছিলেন হয় আর্কিটেক্ট হবেন, না হলে ফটোগ্রাফার।
‘গ্রেট এক্সপেক্টেশনস’ আর ‘অলিভার টুইস্ট’ চার্লস ডিকেন্সের কাহিনী নিয়ে করা এই দুই ছবি খুব টেনেছিল। ‘মঁসিয়ে ভিনসেন্ট’ দেখার পর ক্লোদ রেনোয়াঁর ক্যামেরা ছাড়া আর কিছু মাথাতেই এল না।
একদিন এক ম্যাজিক ঘটল। যাঁর ক্যামেরায় বুঁদ হয়ে থাকতেন সেই ক্লোদ রেনোয়াঁর সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল একেবারে কলকাতার ফুটপাতে! ফরাসি সিনেমার ‘লেজেন্ড’ জঁ রেনোঁয়া ‘দ্য রিভার’ ছবির কাজে কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গেই এসেছিলেন তিনি।
অনেক চেষ্টার পর সিনেমার সেটে থাকার অনুমতি মিলেছিল ‘অবজার্ভার’ হিসেবে। সেই ছিল তাঁর টার্নিং পয়েন্ট। সেই সেটেই দেখা সত্যজিৎ-এর সঙ্গে। সালটা ১৯৫০।
ঠিক দু’বছরের মাথায় তৈরি হল আর এক ইতিহাস। সত্যজিৎ শুরু করলেন তাঁর স্বপ্নের কাজ। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনী নির্ভর ছবি। নাম ‘পথের পাঁচালি’। চিত্রগ্রাহক হিসেবে সেই ছবিতে যোগ দিলেন একুশ বছরের আনকোরা তরুণ। মোশন ক্যামেরা নিয়ে কাজের কোনও অভিজ্ঞতাই নেই যার ঝুলিতে। সম্বল বলতে রেঁনোয়ার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। তাই দিয়েই তৈরি হল ভারতীয় সিনেমার নয়া ইতিহাস। গড়লেন সত্যজিৎ। সঙ্গ দিলেন তিনি। সুব্রত মিত্র।