‘আমি যত দূরেই যাই।/ আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে/ নিকোনো উঠোনে/ সারি সারি/ লক্ষ্মীর পা...’।
ভূমি, ভাষা, ভবিষ্যৎ। এই তিন মিলে তিনি। এই তিন ঘিরে আশ্চর্য ভালোবাসার লেখ্য রূপ তাঁর কবিতা। প্রতিরোধ-প্রেম-কবিতাকে এক সঙ্গে মিশিয়েছিলেন বাঙালির জীবনে। এক নাছোড়বান্দা টান। বারবার ঘরছাড়া করে পাঠককে। পথে নামায়। হৃদয় জাগায়।
তিনি যে পদাতিক কবি। নাম তাঁর সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
ঝাঁকড়া অগোছালো চুল। চোখে কালো ফ্রেমে চশমা। ঝোলা ব্যাগ আর আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। দেখলেই মনে হয় খানিক বাউন্ডুলে, খানিক বেখেয়ালি; ঠিক ঘরের মাপের মানুষ নন। উন্মুক্ত। উদার। পথ হারানোর জন্য বারবার পথে নামতে পারেন।
বাঙালি কবি বলতে যা বোঝে তিনি একেবারে ঠিক তাই।
পথের কবি। ভালবাসতেন মানুষ। আগলহীন মেলামেশা। অঝোর কথার বান। সেখান থেকে যে উঠে আসেন জীবনের গল্প। হাসি, কান্না চোখের জলে মেতে ওঠে কলম।
তাঁর কবিতায় জীবন আসত এভাবেই।
জীবন-কবিতা-রাজনীতি এক সুতোর টানে বাঁধা। প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক কবি বলতে যা বোঝায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাই।
জন্মসূত্রে তিনি কৃষ্ণনাগরিক।
১৯১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্ম। মামাবাড়িতে। বাবা ক্ষিতিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মা ছিলেন যামিনী দেবী। বাবা সরকারের অধীনে আবগারি বিভাগের কর্মচারী। তাঁর বদলির চাকরি হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই দুই বাংলার নানা প্রান্তে বাসের সুযোগ হয়েছিল।
ছোটবেলা কেটেছিল বাংলাদেশের রাজশাহীতে। অবাধ প্রকৃতির মধ্যে শুরু হয় জীবনের প্রথম পাঠ। স্কুল জীবনের বেশ অনেকটা সেখানেই। তারপর কলকাতায়।
ছাত্রাবস্থার প্রায় শেষে জীবনে ঢুকে পড়ে রাজনীতি। পাশাপাশি গান, নাটক।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
স্কটিশ চার্চের ছাত্র ছিলেন। পরে আশুতোষ কলেজ। কিন্তু জীবনে রাজনীতির টান খুব প্রবল তখন চেনা পথের পড়াশোনা আর এগোয়নি।
রাজনীতি। আন্দোলন। কারাজীবন।
ফিরে এসে আবার নতুন শুরু। জীবন তাঁর জোয়ার-ভাটায়। এক সময় সন্দেশ পত্রিকা শুরু করলেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। পত্রিকার অনেকটা দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বাঙালির কাছে এই নাম এক কবির নাম। কিন্তু নিজেকে তিনি কবি বা সাহিত্যিক কোনওটাই বলতেন না।
মানুষের মুখের ভাষা, বুকের কথা, স্বপ্ন, বাস্তবকে তিনি কাগজ কলমে বন্দী করেছিলেন। নিজের সম্পর্কে এই ছিল তাঁর মত। তাঁর কলম আসলে মানুষের মুখের কথাকে লিপিবদ্ধ করেছে মাত্র।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক সময়ের নাম। এক আগুনে সময়। মেধা-মনন-প্রেম-প্রতিবাদে অগ্নিস্নাত হয়ে বেঁচে থাকা এই জাতির প্রতিনিধি তিনি। তাঁর কবিতা কখন যে কবিতা থেকে স্লোগান আর স্লোগান থেকে জীবন দর্শন হয়ে উঠেছে তার হিসেব লেখা নেই।
গর্জে ওঠা রাজপথ থেকে গপ্পো-তক্কোর চায়ের দোকান কিংবা কলেজের দেওয়াল গ্রাফিটি- সবখানে আছেন তিনি। পদ্যে-গদ্যে-প্রতিস্পর্ধায় জেগে আছেন পদাতিক কবি...
আজকের দিনে প্রয়াত হন কবি। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ...