ভোজন রসিক বাঙালির ভোজন রসনার একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে,যা হয়তো অনেকের জানা। কিন্তু যাঁরা জানেন না তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই মূলত ১৮ ও ১৯ শতক থেকে বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির আবির্ভাব- বিবর্তন সবই ঘটেছে সমাজের ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের হাত ধরে। যদিও এর সূচনা ঘটে আর্যদের আগমন থেকে। যার বিস্তৃত বর্ণনা আছে বৈদিক সাহিত্যে। অবশ্য সেখানে খাদ্যের বিভাজনসহ রীতি নীতি সবই উল্লিখিত। পরবর্তীকালে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজার খাদ্যাভ্যাস বিবৃত আছে। বাঙালির খাদ্যাভাসের ইতিবৃত্ত পাই মঙ্গল কাব্যে ও বৈষ্ণব পদাবলীতে।
কিন্তু এত কঠিন তত্ত্বকথা নয়, আজ যে বিষয় নিয়ে বলবো তা হল - খাদ্য সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটে গেছে, তা সে অনেক যুগ হলো। আধুনিক সময়ে সেখানে ঢুকে পড়েছে চিনে, তিব্বত, বিদেশী খাবারের সম্ভার এককথায় মূলত মাল্টি কুইসিনে ভরপুর। চিরাচরিত রীতি ভেঙেছে সে আজ নয় বহুযুগ আগেই তবেই না মোঘলাই খাবার পাতে জায়গা করেছে। সে রীতির আদানপ্রদান মন্দ কি! কিন্তু যে চিরাচরিত খাবার তালিকাভুক্ত ছিল সে কি আজ আর বাঙালিয়ানার অন্তর্ভুক্ত আছে, না কি শুধু বিশেষ দিনে পোশাকেই তার রমরমা সীমাবদ্ধ। সে গপ্পো হোক আজ।
অনেক পরীক্ষামূলক পদ পাতে জায়গা করলেও কিছু পুরোনো দিনের মানুষ ছাড়া আধুনিক প্রজন্ম আদৌ সেই খাবার বা সবজিগুলোর সাথে কি পরিচিত? দেখে নেওয়া যাক ঠিক কি ধরণের ছিল তারা। যেমন ওল, ওল শাক, কেউ, বেতো, সর্ষে, কাল- কাসুন্দে, জয়ন্তী, সিঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাটপাতা, তেলাকুচো, থানকুনি - এতো গেলো শাক। এবার আসি অনন্য স্বাদ যুক্ত ওল, বকফুল, কুমড়োফুল, ডুমুর, শাপলা, সর্ষেফুল কচুরলতি এসব সাদা চোখে বাজারে পাওয়া না গেলেও মাঝে মধ্যে চোখে পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু সুপারমার্কেটের আনুকূল্যে এই প্রজন্ম কি আদৌ এই নামের সাথে পরিচিত? সন্দেহ আছে, বা একটু একালের ধরণে হয়তো শোনা যাবে এসব কি! খাবার?
আবার কিছু সবজি তাদের পছন্দের তালিকায় চেষ্টা করেও জায়গা করতে পারে নি যেমন লাউ, মোচা, থোড়, ডয়াকলা, অড়হর ডাল, কুমড়ো, বাঁধাকপি, মূলো এইসব যা সবসময়েই পাওয়া যায়। এই সবজিগুলোর খাদ্যগুন অপরিসীম, কিন্তু বিদেশী সবজির গুণ খানিক বেশি এবং সময়ের স্বল্পতার কারণেই এদের প্রায় লুপ্তপ্রায় দশা। কিন্তু এই খাবারগুলো যথার্থ পরিবেশনা হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আবার এদের অন্তর্ভুক্তি ঘটবে।
কাঁচা তেল, কাসুন্দি দিয়ে কচু বাটা, সর্ষের তেল, কাসুন্দি দিয়ে ওল বাটা, কুমড়ো ফুলের বড়া, পাট পাতা, শিউলি পাতার বড়া, ডালের বডার ডালনা, ডালের ধোকা, লাউয়ের চাপড ঘন্ট, ডালের বড়ি দিয়ে মোচার ঘন্ট, পুঁই মেটের চচ্চড়ি, পুর ভরা পটল, উচ্ছের বড়া, ডুমুরের ঝাল, বকফুলের বড়া, ডয়াকলার ডালনা, মোচার পাতুড়ি, কাঁকরোল বাটা, লাউয়ের খোসা ভাজা, খোসা বাটা, ভাঙা চোরা শুক্ত - এইসব আজ অচল প্রায়। কিন্তু স্বাদে অতুলনীয়। স্বাস্থ্যের ও ভেজালের কারণে এসবের রান্নার অনুপানে কিছুটা ঘাটতি হলেও এই সবজি ও পদগুলি নিজ গুনেই সুস্বাদু ও আরো ভালো করে বলতে গেলে বিদেশী সবজির থেকে দামেও কম ।
যদিও বেশ কিছু বাঙালি রেঁস্তোরায় কিছু পুরোনো পদকে ফিরিয়ে এনে স্মৃতিচারণ করছে তাও বিশেষ উৎসবে। কিন্তু এই লুপ্ত প্রায় সব্জিগুলোর খাদ্যগুন থাকলেও সময়ের কারণে তা আজ কিছুটা মলিন - তবে এর স্বাদ যদি যথার্থ ভাবে আস্বাদন করা যায় হলফ করে বলাই যায় এরা আবার স্বমহিমায় বাঙালির পাতে জায়গা করে নেবে- তাতে কিন্তু বিদেশী খাবারের পশ্চাদপসারণ ঘটলেও ঘটতে পারে।