সেতার-সম্রাট রবিশঙ্কর

রবিশঙ্করের বয়স তখন খুব বেশি না, মাত্র আঠেরো। মাইহারে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-সাহেবের কাছে সেতার শেখার জন্য নাড়া বেঁধেছিলেন। খাঁ-সাহেবের ছিল একেবারে শাহী মেজাজ।

বার বার দেখিয়ে দিলেও কেউ যদি রাগের রূপ হাতে আনতে না-পারতেন কিংবা চর্চায় শিথিলতা দেখাতেন, তাহলেই তাঁর মেজাজ যেত বিগড়ে। তখন বকুনির চোটে বাড়ি মাথায় করতেন, এমনকি ঘা কতক লাগিয়ে দিতেও কসুর করতেন না। 

যাই হোক, রবিকে বড় ভালবাসতেন  গুরুজি, নিজের ছেলের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। সেই অসীম স্নেহের বশে কোনদিন রবির ওপর হাত তোলেননি। কিন্তু, একবার মাত্র বকেছিলেন। হ্যাঁ, ওই একবারই। সেই ঘটনার কথাই বলছি :

প্রতিদিন দুপুরে সেতার শিখতে ওস্তাদজির কাছে যেতেন রবি। একদিন দুপুরবেলায় গিয়েছেন। গুরুজির সেদিন মন একেবারেই ভালো ছিল না, তার ওপর রবিকে শেখাতে শুরু করেছিলেন জমজমার এক কঠিন গৎ। 

তায় দুই হাতের কঠিন ফিঙ্গারিং  কিছুতেই ঠিকঠাক হচ্ছিল না রবির। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ বারেও যখন হল না, তখন মেজাজ হারালেন খাঁ-সাহেব। একটু রেগেই বললেন, 'তোমার হাতে জোর নাই? যাও, চুড়ি কিন্যা পর গিয়া!' 

ব্যস, গুরুজির শ্লেষ রবির অন্তরে গিয়ে লাগল। চোখ ফেটে জল এল। ভারি অভিমান হল তাঁর। উঠে চলে গেলেন সেখান থেকে। মন বলল, এখানে আর থাকবই না। মনে হল, তাঁর ওপর থেকে গুরুজি যেন সব ভালোবাসা সরিয়ে নিয়েছেন।

তাহলে এখানে থেকে আর কী হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাওয়াই ভালো। নিজের ঘরে এসে বেঁধে ফেললেন বিছানা, গুছিয়ে ফেললেন বাক্স। ট্রেনের টিকিটও কিনে নিয়ে এলেন। ট্রেন পরদিন দুপুরে। 

পরদিন সকালে খাঁ-সাহেবের পুত্র আলি আকবর এলেন রবির ঘরে, প্রতিদিন সকালে যেমন আড্ডা দিতে আসেন সেভাবেই খুশ মেজাজে এলেন। তিনি ভেতরের এতকিছু একেবারেই জানতেন না। দু'জনেই প্রায় সমবয়সী, দু'জনেই খুব ভালো বন্ধু। তিনি রবির ঘরে ঢুকে সব কিছু বাঁধাছাঁদা, গোছগাছ হয়ে গেছে দেখে একেবারে অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কি? 

তখন রবি তাঁকে খুলে বললেন সব কথা। সব শুনে আলি আকবর তাঁকে অনেক বোঝালেন। বললেন, রবি তুমি জানই তো বাবার কেমন মেজাজ। আমি ওনার ছেলে, তবু আমাকে গাছে বেঁধে তিনদিন কী মার মেরেছেন সে তো তুমি দেখেইছ। আর সকলেই জানে উনি তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন, তুমিও তো সেটা জানো। তাহলে?

রবিকে এভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাবার খেতে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলেন আলি আকবর। 

রবি বাড়িতে এসেছেন শুনে খাঁ-সাহেব তাঁকে ভেতর ঘরে ডেকে পাঠালেন। যখন রবি ভেতরে গেলেন, তখন খাঁ-সাহেব পেছন ফিরে দেওয়ালে রবির ছবি টাঙাচ্ছিলেন। ছবিটি পেরেকে এঁটে খাঁ-সাহেব সামনের দিকে ফিরতেই মুখোমুখি হলেন রবির। রবি দেখলেন গুরুজির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি, চোখ ভরা জল। গুরুজি বললেন, ‘দেখসো, তুমার ফুটঅ লাগাইতাসি। আর আমারেই ছাইড়া চইলা যাইবা!’ 

শুধু এইটুকু কথা, আর বলতে পারলেন না, গলা কেঁপে উঠল তাঁর। সেই কথায়, তাঁর স্বরে এমন এক গভীর স্নেহ ছিল, এমন একটা কষ্ট ছিল যে, তাতে রবির বুকের ভেতরটাও মোচড় দিয়ে উঠল। তিনিও ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন।

তখন খাঁ-সাহেব এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন রবিকে। তারপর দু’জনের সে কী কান্না! সেই কান্নায় ভেসে গেল মান অভিমানের পালা। রবিশঙ্কর গুরুর বুকে পেলেন পিতার আশ্রয়।    

১৯২০'র ৭ এপ্রিল, বেনারসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবিশঙ্কর চৌধুরি।  কিন্তু, নামের গৌরবে পদবী একদিন পদ খুইয়েছিল,  শুধু প্রথম নামেই হয়েছিল বিশ্বজয়। রবিশঙ্কর চৌধুরি পরিচিত হয়েছিলেন, 'সেতার সম্রাট রবিশঙ্কর' নামে। 

রবি মাত্র দশ বছর বয়সেই দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালে ট্রুপে কখনো নেচেছেন, কখনো বাঁশি বাজিয়েছেন, কখনো বা এস্রাজ বাজিয়েছেন, কখনো বা সেতার। ওস্তাদদের বাজানো দেখে আর রেকর্ডে বাজনা শুনে শুনে তাঁর যন্ত্রশিল্পে হাতেখড়ি।

বাবা ও ঠাকুদার পরম্পরা বেয়ে সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ছোট থেকেই খুব টান। বাবাই তাঁকে সব রকম বাদ্যযন্ত্র বাজানো ছেড়ে একটি নির্দিষ্ট বাদ্যযন্ত্রের দিকে মনোনিবেশ করতে বললেন, তখন রবি সেতারকেই বেছে নিলেন। তারপর প্রথাগত শিক্ষা নিতে নাড়া বাঁধলেন গিয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-সাহেবের কাছে। 

আসলে, দাদার ট্রুপে তিমিরবরণ সেতার বাজাতেন, তাঁর কাছে খাঁ-সাহেবের কথা শুনে রবির মনে জেগেছিল তাঁকেই গুরু হিসেবে পাবার আকাঙ্ক্ষা।  সেই গুরুর আশীর্বাদেই রবিশঙ্কর বিশ্বের দরবারে প্রথম পৌঁছে দিয়েছিলেন ভারতীয় রাগসঙ্গীত, বিশ্ববাসীর অন্তরে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের সুমহান ঐতিহ্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...