কায়িক-মৃত্যুর একশো বছর পরও বাঙালির জেগে ওঠার ইতিহাসে তিনি আজও জাজ্বল্যময়ী। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, 'লোকমাতা'। অরবিন্দ বলেছিলেন, 'শিখাময়ী'। তাঁর এই দুই সত্ত্বাকেই অনুভব করেছিলেন বিবেকানন্দ। আমাদের সেই 'তিনি' হলেন পূর্বাশ্রমের 'মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল', সন্ন্যাস-আশ্রমের 'ভগিনী নিবেদিতা'। তিনি অবশ্য নিজের নাম যখন সই করতেন, তখন লিখতেন, 'Nivedita of Ramkrishna-Vivekananda'.
লন্ডনে বিবেকানন্দের সঙ্গে আইরিশ মার্গারেটের যখন দেখা হল, তখন মার্গারেট একইসঙ্গে শিক্ষিকা, ঈশ্বর-সন্ধানী এবং ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রবল আগ্রহী। তাঁকে আমূল জেনে এ-দেশের কাজে লাগাতে চাইলেন বিবেকানন্দ। সতীর্থ স্বামী অভেদানন্দকে বললেনও সে-কথা। বললেন, "মিস নোবল খুব 'good soul' এবং এডুকেশন লাইনে আছে। তাই ভাবছি মেয়েদের জন্য যে স্কুল গড়ার পরিকল্পনা আমার আছে তার সকল দায়িত্ব ওকে দেব। মনে হয় ও পারবে।" মার্গারেট নিবেদিতা হয়ে গুরু বিবেকানন্দের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে প্রকৃত শিষ্যার কর্তব্য যেমন পালন করলেন, তেমনি প্রমাণ করলেন গুরুর আস্থা যথার্থপাত্রেই অর্পিত হয়েছে। সিদ্ধিপথ ও কর্তব্যপথে তাঁর জপমন্ত্র হল, 'ভারতবর্ষ! ভারতবর্ষ!! ভারতবর্ষ!!! মা! মা! মা!'। আত্মগত এই মাতৃবন্দনায় ভারতবর্ষ তাঁর স্বদেশ হলেন, হয়ে উঠলেন 'মা'।
স্কুল তৈরি হল। বাগবাজারের বোসপাড়া লেনে। নাম হল, 'ভগিনী নিবাস'। কেননা, বাস্তবিকই ১৭ নম্বর বাড়িটিতে নিবেদিতা বাস করতেন। সঙ্গে থাকতেন সতীর্থ ক্রিশ্চিয়ানা। খেলতে খেলতে শিক্ষা--এই ছিল নিবেদিতার শিক্ষাপদ্ধতি। ছোট ছোট মেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্কা বাল্যবিধবা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল বিদ্যালয়ের দরজা। স্কুল চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থসংস্থানের জন্য নিবেদিতা নিজে খাবার-খরচ নিতান্তই সংকুচিত করে কৃচ্ছ্রসাধনা তো করতেনই, সেইসঙ্গে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতেন। 'ভগিনী নিবেদিতা'-প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন, "তিনি যে ইহার ব্যয় বহন করিয়াছেন তাহা চাঁদার টাকা হইতে নহে, উদ্বৃত্ত অর্থ হইতে নহে, একেবারেই উদরান্নের অংশ হইতে।"
বিবেকানন্দের মৃত্যুর ছ'মাসের মধ্যেই অরবিন্দর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল নিবেদিতার। বিবেকানন্দের আদর্শকে মাথায় রেখেই গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের কাজ করতে চাইলেন তিনি। তিনি আইরিশ হোমরুল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে থাকতে। বিপ্লব পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা তাঁর যথেষ্ট। কাজেই বরোদায় অরবিন্দ তাঁকে বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। কিন্তু, বিপ্লব-পথের সঙ্গে তাঁর এই সদরযোগ বেলুড় মঠের তৎকালীন প্রধান স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাখাল মহারাজ) ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা মেনে নিলেন না। তাঁরা নিবেদিতাকে ডাকিয়ে বললেন, "হয় তুমি রাজনীতি ছাড়, না হয় আমাদিগকে ছাড়। এই দুইয়ের একটি পথ তোমাকে বাছিয়া লইতে হইবে।" বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী হলেও উগ্র দেশপ্রেমিক ছিলেন। নিবেদিতা বুঝলেন কর্তৃত্বের পরিবর্তনে অবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি বললেন, "রাজনীতি আমি ছাড়িতে পারিব না। আমি উহার সহিত একাত্ম হইয়া গিয়াছি। আমি বরং প্রাণ ত্যাগ করিব, তবু উহা ছাড়িব না।।" মঠ ছাড়তে এভাবে বাধ্য করিয়ে নিবেদিতাকে দিয়ে 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ানো হল যে, তিনি স্বেচ্ছায় মঠ ছেড়েছেন! নিবেদিতা মঠ ও স্কুল চালানোর জন্য কিছু অর্থ-সাহায্য পেয়েছিলেন, সে-টাকাও তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হল। তিনি অনায়াসে কপর্দকশূন্য হলেন, কিন্তু মাথা নোয়ালেন না।
আজন্ম ভারতবাসীর চেয়ে নিবেদিতা ভারতবর্ষকে বেশি ভালোবাসতেন, একজন জন্মগত হিন্দুর চেয়ে হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর বেশি পণ্ডিত্য ছিল, স্বদেশিয়ানার প্রতি বেশি শ্রদ্ধা ছিল, একজন হিন্দুর চেয়ে তিনি বেশি হিন্দু ছিলেন। শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্কসূত্রে তাঁর স্কুলে রবীন্দ্রনাথের যাতায়াত ছিল। বুদ্ধগয়া ভ্রমণের সঙ্গীও হয়েছিলেন। ফলে, নিবেদিতাকে অত্যন্ত কাছ থেকে তিনি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। শিল্পীর নিরাসক্ত মন নিয়ে তাঁকে অনুধাবন করেছেন। তাই ভারতবর্ষে তের বছর অবস্থান করে উনিশশো এগারো সালে তেরই অক্টোবর নিবেদিতা যখন মারা গেলেন, তার ঠিক তের বছর পর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'গোরা' উপন্যাস। গোরাকে তৈরি করলেন একেবারে নিবেদিতার আদলে; জন্মসূত্রে আইরিশ, অন্তরঙ্গে খাঁটি ভারতীয়, দীর্ঘদেহী, গৌরাঙ্গ, দম্ভী হিন্দু, মানবতাবাদী, মানবদরদী, পণ্ডিত্যময়, চরিত্রবলে দীপ্তিমান, কৃচ্ছ্রসাধক, উন্নতশির...
তথ্যঋণ : 'নিবেদিতা স্মৃতি'- বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত।