'চণ্ডীমঙ্গল' রচয়িতা মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্যে কালকেতু ও ফুল্লরা যে রাজযোটক, সেটা বোঝাতে 'হাঁড়ির মুখে সরা' উপমাটি ব্যবহার করেছিলেন। এই উপমাটি সঙ্গীতসাধক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও উৎপলা সেন সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
কারণ, দাম্পত্যজীবনে তাঁরা ছিলেন একে অপরের অনুপম পরিপূরক। সেজন্যই বুঝি অনুরাগীরা দু'জনকে এক নামে ডাকতেন, 'উৎসতীপলানাথ' বলে।
তাই, সতীনাথকে উপেক্ষা করে উৎপলার আলোচনা সম্ভব নয়। আসলে, তাঁদের দাম্পত্যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার অন্ত ছিল না। দু'জনের মিলনও রচিত হয়েছিল দুর্বিপাক ও দৈবের অনুগ্রহে। সে-সব কথায় একটু পরে আসছি, শুরুর কথা আগে শুরুতেই বলি:
ঢাকার বনেদি ঘোষ-বাড়িতে উৎপলার জন্ম। বাবা বেশ রক্ষণশীল মানুষ। সে রক্ষণশীলতায় বাড়ির মেয়েদের গানবাজনা করা মানা। কিন্তু, মা হিরণবালার প্রশ্রয় পেলেন উৎপলা। তিনি ভালো গান জানতেন। তাঁর কাছেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি হল।
কণ্ঠে যখন উৎপলা গান নিলেন; তখন বাধাটা আর বাধা হয়ে থাকল না। বাবা বুঝলেন মেয়ের কণ্ঠে সুধার ঝর্ণাধারা আছে, সুর বেয়ে যা বুকে এসে থিতোয়। তাই মেয়েকে মনের মতো করে গান শিখতে দিলেন ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ-সাহেবের কাছে। তারপর ঢাকা রেডিও-তে গাওয়ার সুযোগ হল, তাতেও বাধা দিলেন না।
উৎপলা যখন রেকর্ডে গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন, তখন মেয়ে যাতে ভালোভাবে গানবাজনা চালিয়ে যেতে পারেন তার জন্য বাবা কলকাতাতেই মেয়ের বিয়ে দেবার কথা ভাবলেন। খোঁজখবর নিয়ে কলকাতা কর্পোরেশনের চাকুরে বেণু সেনের সঙ্গে বিয়েও দিয়ে দিলেন।
বেণু সেন বনেদি বাড়ির ভালো ছেলে। তাঁর সঙ্গে বিয়ের পর 'উৎপলা ঘোষ' হয়ে গেলেন, 'উৎপলা সেন'। স্বামী-শাশুড়ি নিয়ে তাঁর সুন্দর সংসার হল; গানবাজনায় অবাধ উৎসাহ পেতে লাগলেন, অসম্ভব সুখ হল। তাঁদের উৎসাহেই উৎপলা আকাশবাণীতে যোগ দিলেন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে।
রেডিও ও রেকর্ডের সুরধারা বেয়ে এপার বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল উৎপলার নাম। তারই মধ্যে উৎপলা পুত্রসন্তানের জননী হলেন। তখন ভরা সংসারে সুখ যেন একেবারে উপচে পড়ল।
কিন্তু, সুখ কিছুতেই সইল না। মা-পুত্র-স্ত্রীকে রেখে বেণু সেন হঠাৎ একদিন মারা গেলেন। স্বামীর এই আকস্মিক মৃত্যুতে উৎপলা হতভম্ব হয়ে গেলেন, একা হয়ে গেলেন, নিভৃতচারিণী হয়ে উঠতে লাগলেন। শাশুড়ি-বন্ধুবান্ধব সকলেই চেষ্টা করতে লাগলেন, তাঁকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে। কিন্তু, পারলেন না।
তখন একদিন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত বন্ধু সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এলেন উৎপলাদের বাড়ি। উদ্দেশ্য, খানিক গল্পগুজব ও গানবাজনা করে উৎপলাকে ট্রমা থেকে বার করা।
খানিক কথাবার্তার পর সতীনাথ হারমোনিয়াম টেনে একের পর এক গান গাইতে শুরু করলেন। সতীনাথের দরদী কণ্ঠ একদা উৎপলার হৃদয় ছুঁল। অনেকদিন পর তাঁর মুখে ফুটে উঠল সেই মর্মস্পর্শী সঙ্গীতরসে ডুব দেবার আনন্দ। এই পরিবর্তনটুকু দেখেই শ্যামল এবং শাশুড়ি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
শাশুড়ি উৎপলাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। তিনি চাইতেন উৎপলা জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করুন। ভাবলেন, যে মানুষ উৎপলার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, সেই মানুষই যদি জীবনসঙ্গী হন, তার চেয়ে ভালো আর হয় না।
তাই তাঁর আগ্রহেই বাড়িতে সতীনাথের যাতায়াত বাড়ল। উৎপলা ও সতীনাথের মধ্যে একটা ভালো লাগা তৈরি হতেই তিনি উদ্যোগী হয়ে দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। এই যে তিনি এক পথের দুই পথিককে মিলিয়ে দিলেন, মৃত্যু ছাড়া আর কোনকিছুই তাঁদের সারাজীবনে বিচ্ছিন্ন করতে পারল না।
উৎপলা ও সতীনাথ যেখানেই যান একসঙ্গে যান। গানের মঞ্চেও দুজনের উপস্থিতি পাশাপাশি। সতীনাথ হারমোনিয়াম বাজান, আর উৎপলা গান করেন। এইচএমভি'র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন, তাও একসঙ্গে।
একটা সময় এইচএমভি-তে উৎপলার রেকর্ড বিক্রি কম হচ্ছিল বলে কোম্পানি জানাল যে, সতীনাথ যেমন রেকর্ড করছেন করুন, কিন্তু উৎপলার রেকর্ড তাঁরা করবেন না। প্রস্তাবটা সতীনাথের কাছে বিষবৎ মনে হল। প্রতিবাদে তিনি এইচএমভির রেকর্ড করাই ছেড়ে দিলেন। এমনি ছিল তাঁদের আপোষহীন ভালোবাসা।
রানি এলিজাবেথ থেকে শুরু করে সরোজিনী নাইডু, পদ্মজা নাইডু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, কিশোর কুমার, উত্তম কুমার, প্রেসিডেন্ট এরশাদের মতো মানুষেরা উৎপলার কণ্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হতেন; তাঁর কণ্ঠে 'প্রান্তরের গান আমার', 'ঝিকমিক জোনাকির দ্বীপ জ্বলে', 'শান্তি দিলে ভরি', 'শুকতারা গো', 'হরিনাম লিখে দিও'-এর মতো কালজয়ী গান শুনে এখনও শ্রোতারা মন্ত্র-আবেশে মুগ্ধ হন। এর রহস্যটা কী?
রহস্য একটাই, সেটা আপোষহীন নিষ্ঠা।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'কথায় কথায় রাত হয়ে যায়' স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন যে, একবার উৎপলার দারুণ অভিমান হল। অভিমান-থমথমে মুখে তিনি নির্জনে চুপ করে গিয়ে দাঁড়ালেন। চোখ বেয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল অশ্রু।
কারণ, কয়েক বছর ধরে পুলক তাঁদের জন্য পুজোর গান লিখছেন ঠিকই; কিন্তু আগে লিখছেন সতীনাথের জন্য, উৎপলার জন্য লিখছেন পরে।
উৎপলার ধারণা, আগে যেটা লেখা হয়, ভালো লেখাটা তখনই বেরিয়ে আসে; পরেরটা অত ভালো হয় না। তাহলে, পুলক উৎপলার জন্য আগে কেন লিখবেন না!
এই যে ভালগানটা তাঁরই হবে, তিনি সেটা মনপ্রাণ দিয়ে গাইবেন; তার জন্য একচুল আপোষ করবেন না, সতীনাথের জন্যও না, সতীনাথ বললেও না-এমন যাঁর মনোভাব তাঁর গাওয়া গান স্বর্গীয় হবে না?
আর একবারের ঘটনা। সতীনাথের সুরে এইচএমভি-তে একটি গান টেক হবার পর রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে উৎপলার মনে হল যে, তিনি ঠিক গাইতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে সতীনাথকে বললেন যে, আর একবার গাইতে চান।
কিন্তু, কর্তৃপক্ষ রাজি হলেন না। তাঁরা গানটি শুনে বললেন, একদম ঠিক আছে। সেদিন একরাশ অতৃপ্তি নিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন উৎপলা। এই অতৃপ্তি তাঁর সারাজীবন ছিল বলেই, নিষ্ঠা নিয়ে অপরের প্রাণের কাছাকাছি সুরের স্রোতসুধা বেয়ে তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন...