তালাত মাহমুদ ও তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর

কে এল সায়গলকে আদর্শ করে সবাক ছায়াছবির দ্বিতীয় দশকে যে-সব শিল্পীর উত্থান হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে মুকেশ, কিশোর কুমার, তালাত মাহমুদের প্রথম দিকের গানগুলিতে কি গায়নভঙ্গি, কি কণ্ঠ-সাযুজ্যে সবেতেই সায়গলকে বড্ড চেনা যায়। 

সায়গল ছিলেন সে যুগের গায়ক-নায়ক, এঁরা সেক্ষেত্রেও সায়গলের পদচিহ্ন অনুসরণ করেছিলেন। তবে, অভিনেতা-নায়ক হিসেবে সফল হয়েছিলেন একমাত্র কিশোর কুমার। মুকেশ বা তালাত মাহমুদ দু’জনই কিন্তু চরমভাবে ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হলেও তালাতের ঝুলিতে অভিনীত ছবির সংখ্যা নেহাত কম নয়, তাদের মধ্যে—‘দিল-এ-নাদান’, ‘বারিস’, ‘ডাকবাবু’, ‘এক গাঁও কি কাহানি’, ‘সোনে কি চিড়িয়া’ উল্লেখযোগ্য। 

Talat-Mahmood1

নায়ক হিসেবে ব্যর্থ হন বা সফল, এঁরা বুঝেছিলেন যে নিজস্বতা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। ফলে, কিছুদিনের মধ্যেই সায়গলের অনুকরণ ছেড়ে নিজস্ব গায়নরীতি খুঁজে নিয়ে নিজস্ব কণ্ঠে গান গেয়ে শ্রোতাদের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন।

তালাতের বাড়িতে গানবাজনা নিষিদ্ধ ছিল। বাবা এসব পছন্দ করতেন না, ‘হারাম’ মনে করতেন। তবুও, কীভাবে তালাত গায়ক হলেন, কীভাবে নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখলেন, সে-সবের মূলে আছে গল্প। সেই গল্পই আজ বলবঃ 

হ্যাঁ, বাবা চাইতেন না যে, বাড়ির কেউ গানবাজনা করুক। কিন্তু, যন্ত্রে গানবাজনা হলে সেটাকে ‘হারাম’ মনে করতেন না। ফলে, বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল। তাতে কে এল সায়গলের গান শুনতে বড্ড ভালোবাসতেন ছোট্ট তালাত। শুনতে শুনতে সেই বয়সেই নিজের অজান্তে কখন যেন হয়ে উঠলেন সায়গলের অন্ধ ভক্ত। সেখান থেকেই তৈরি হল গানবাজনার প্রতি অদম্য দুর্বলতা।

পিসির বাড়ি আবার ছিল চরম উদারপন্থী। সেখানকার মুক্ত বাতাসে মাঝেমাঝেই ‘মেহফিল’ বসত। আসতেন, শহরের নামকরা সব গাইয়ে-ওস্তাদ। গজলে মুখরিত হয়ে উঠত আবহ। এই আবহের টানে হামেশাই তালাত পালিয়ে আসতেন পিসির কাছে। 

পিসি করিৎকর্মা মহিলা। তাঁর আশকারাতেই গোপনে গান শিখতে লাগলেন তালাত। এমনকি এটা জানাজানি হওয়ার পরও বাপ-ছেলের মধ্যে সংঘাত বাঁধতে দিলেন না তিনিই। তালাতের বাবা অর্থাৎ আপন দাদাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একেবারে মিরাকল ঘটিয়ে ফেললেন। তালাত যাতে অবাধে সঙ্গীতচর্চা চালিয়ে যেতে পারেন এবং সঙ্গীত নিয়ে পড়তে পারেন, তার অনুমতিটিও আদায় করে ফেললেন।

Talat-Mahmood2

তালাত ভর্তি হয়ে গেলেন লখনউ-এর মরিশ মিউজিক কলেজে। সেখানে শাস্ত্রীয় ও লঘু সঙ্গীতের পাশাপাশি ভালোভাবে গালিব, মীর, ইকবালের গজল আয়ত্ত করে ফেললেন। সঙ্গীতে স্নাতক হলেন। রেডিওতে গাইতে শুরু করলেন।

কলকাতায় এইচ এম ভি-তে তখন গজল গায়কের খুব চাহিদা। বন্ধুর সূত্রে যোগাযোগ হল, তালাত কলকাতায় হাজির হলেন। রেকর্ড হল দু’খানা গান, গজল নয়, নন ফিল্মিঃ ‘তুম লোকলাজ সে ডরতি থি’ এবং ‘সব দিন এক সমান নহি’। এ দুটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গান। এই দুটি গানে সায়গলের ছাঁচ স্পষ্ট বোঝা যায়।

কলকাতায় এসে তালাত সুরকার পঙ্কজ মল্লিক ও কমল দাশগুপ্তর সান্নিধ্য পেলেন। তৈরি হতে লাগল তাঁর নিজস্ব পথ। মূলত কমল দাশগুপ্তর পরিচর্যায় তিনি নিজের কণ্ঠে গাইতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে তাঁর গলায় একটা কাঁপা কাঁপা টেক্সচার পাওয়া গেল, যেটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠল তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর। শ্রোতার ভালো লাগা শুরু হল।

এই সময় কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘তসবির তেরি দিল মেরা বহেলা ন সকেগি’ গানটির রেকর্ড বেরুল। আর বেরোতেই সে গান এতটাই জনপ্রিয় হয়ে গেল যে, গানের কলি লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল, ফিরতে লাগল গায়কের নাম। গানটি তালাতের কেরিয়ারে মাইল স্টোন হয়ে গেল।

শুধু হিন্দি গানেই থেমে থাকলেন না, এইচ এম ভি’র জন্য প্রায় শ’দেড়েক বাংলা গান গেয়ে ফেললেন ‘তপন কুমার’ নামে। কমল দাশগুপ্ত ছাড়াও সুরকারের হিসেবে পেলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, কানু ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, ভি বালসারার মতো স্বনামধন্যদের। রচিত হল, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’, ‘শোন গো সোনার মেয়ে’, ‘চাঁদের এত আলো’, ‘রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে’, ‘এই রিম ঝিম ঝিম বরষায়’, ‘যেথা রামধনু ওঠে হেসে’র মতো কালজয়ী গান।

Talat-Mahmood3

বাংলা জয় করে লখনউর ছেলে তালাত পাড়ি দিলেন বম্বে, পাঁচের দশকের দোরগোড়ায়। শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পেলেন অনিল বিশ্বাসের মতো বিশিষ্ট সুরকারকে। শুরু হল তালাতের ফিল্মি-গানের কেরিয়ার। অনিল তালাতকে তাঁর ‘আরজু’ ছবিতে গাওয়ার সুযোগ দিলেন। তালাতের গাওয়া ‘এ দিল মুঝে’ গানটি এতটাই জনপ্রিয় হল যে, নৌসাদ ও গুলাম হায়দরের মতো উঁচুদরের সুরকারদের দরজাও তাঁর কাছে খুলে গেল। এই সুসময়ের মধ্যেই এমন একটা রটনা বোম্বাইয়ের সিনেমহলে চারিয়ে দেওয়া হল, যাতে তালাতের উঠতি কেরিয়ার ডুবে যাওয়ার জোগাড় হল।

রটানো হল যে, তালাতের গলার কাঁপা কাঁপা ব্যাপারটা নাকি কোন ম্যানারিজম নয়। আসলে গাইতে গেলেই তালাত ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েন, আর তাতেই নাকি তাঁর কণ্ঠ কেঁপে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, রটনা অনেকেই বিশ্বাস করে ফেললেন। ফলে, খোলা দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। নার্ভাস গায়ককে দিয়ে কে গান করাবে! দেশে গায়কের অভাব আছে নাকি!

এই পরিস্থিতিতে একেবারে মুষড়ে পড়লেন তালাত। তবে কি তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল! তারপর একসময় ভাবলেন, না, এতদূর এসে হাল ছাড়লে তো হবে না। ফলে, হাল না-ছেড়ে মরিয়া হলেন। কণ্ঠে যাতে কোনরকম কাঁপুনি না-আসে, সচেতনভাবে সেটাই অভ্যেস করতে লাগলেন। ঠিক এই সময় আবার তাঁকে ডাকলেন অনিল বিশ্বাস।

অনিল বিশ্বাসের হাত ধরেই ফিল্মি গানের জগতে তালাতের প্রবেশ। কেরিয়ার ডোবার সময়ও সেই অনিলই এসে হাত ধরলেন। 

কারদার স্টুডিওতে গানের রেকর্ডিং। তালাত একটার পর একটা টেক দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু অনিলের মনোমত কিছুতেই হচ্ছে না। এক সময় অনিল তালাতের কাছে গেলেন, পিঠে হাত দিয়ে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার শরীর কি খারাপ? সেরকম হলে আজ এখানেই রেকর্ডিং বন্ধ রাখছি, না-হয় অন্যদিন করব।

তালাত সবিনয়ে বললেন যে, তাঁর শরীর ঠিক আছে। তিনি বুঝতে পারছেন, অনিল যা চাইছেন, সেটা তিনি দিতে পারছেন না। দয়া করে অনিল যেন তাঁকে নির্দ্বিধায় বলেন যে, ভুলটা তাঁর কোথায় হচ্ছে, তাহলে শুধরে নিতে চেষ্টা করবেন।

তখন অনিল বললেন যে, তালাতের গলার যে পরিচিত কাঁপা কাঁপা আবেদন, সেটা পাচ্ছেন না বলেই তাঁর মনে এল শরীর খারাপের কথা। ওই কাঁপা কাঁপা ব্যাপারটাই তাঁর চাই।

এ-কথা শুনে তালাত তাঁকে রটনার কথা সমস্তটা খুলে বললেন। বললেন, কেমন করে নিজেকে বাঁচাতেই কণ্ঠের কাঁপুনি বন্ধের জন্য সচেতনভাবে মেহনত করছেন। 

Talat-Mahmood4

সব শুনে অনিল তাঁকে আশ্বস্ত করে উপদেশ দিয়ে বললেন, শোন, অন্যের মিথ্যে রটনায় নিজের সম্পদকে আর কখনো অবহেলা করো না। ওই কাঁপুনিটা তোমার বৈশিষ্ট্য, তোমার সম্পদ, সিগনেচার, শ্রোতারা সেটা পছন্দ করে, চেনে। কারও কথায় ওটা পরিবর্তনের দরকার নেই।

অনিলের এ-কথায় তালাত তাঁর হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে রাখতে আরও দেড় দশক ধরে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে উড়িয়ে গেলেন বিজয় কেতন; কণ্ঠ দিলেন ‘তারানা’, ‘বাবুল’, ‘পরছাই’, ‘রাগরঙ্গা’, ‘অম্বর’, ‘বেবফা’, ‘দায়রা’র মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছবিগুলোতে; হয়ে উঠলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। সর্বকালের সেরাদের একজন।

 

তথ্যঋণঃ ‘নই দুনিয়া’ পত্রিকা, ১৯৮৯

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...