নৈহাটির এক গানপাগল

বাবা নাম করা ডাক্তার। ছেলে গান ছাড়া আর কিছু জানে না। গানের জন্য সব কিছু ছাড়তে পারে সে। বাবা কিন্তু মোটেই প্রশ্রয় দিতে রাজী নন ছেলের এমন পাগলামি। একদিন গানের টানে ঘর ছাড়ল ছেলে। অবাধ্য ছেলেকে তখনও মানতে নারাজ বাবা।
এ গল্পের টান মনে করিয়ে দেবে "দেয়া নেয়া" ছবির কাহিনীর কথা। একদিকে গান পাগল উত্তম আর অন্যদিকে তার নারাজ জেদি রাশভারী বাবা কমল মিত্র।
তবে বাবা-ছেলের এ গল্প খুব একটা মিথ্যে নয়। "দেয়া নেয়া" ছবির কাহিনী আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ছবির প্রযোজকের জীবনের সঙ্গে। এ ছবির গানে সুরও দিয়েছিলেন তিনি।
সঙ্গীত পরিচালকের নাম শ্যামল মিত্র। এ গল্প যেন তাঁরই সঙ্গীত জীবনের শুরুর দিনগুলোর ছবি।
আদি বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার নৈহাটিতে। বাবা সাধন কুমার মিত্র ছিলেন ড. বিধান রায়ের ছাত্র। শুরু থেকেই চেয়েছিলেন বাড়ির বড় ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু ছেলের স্বপ্ন গায়ক হওয়ার।
আইপিটিএ করতেন। বন্ধুত্ব ছিল সলিল চৌধুরির সঙ্গে। তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। হুগলী মহসিন কলেজের সিনিয়র। জুনিয়র শ্যামলকে তিনি পরামর্শ দিলেন গানে উন্নতি করতে চাইলে গন্তব্য হওয়া উচিত কলকাতা।
একমাত্র ধ্যানজ্ঞান গান। তাই মাথায় অন্য ভাবনার অবসর নেই। নৈহাটির প্রাসাদ ছেড়ে শ্যামল তাই ঠাঁই নিলেন লেক মার্কেটের মেসে।
কাছেই গান জগতের এক সারস্বতের বাড়ি। যাঁর গান শুনে মুগ্ধ শ্যামল। ইচ্ছে সেই মানুষটির কাছেই নাড়া বাঁধবেন।
৫ নম্বর জনক রোডে থাকতেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। মেস থেকে বেরিয়ে শ্যামল একদিন সরাসরি চলে গেলেন তাঁর বাড়ি।
নৈহাটি থেকে আসা গানপাগল ছেলেটিকে মন্দ লাগেনি তাঁর। শিষ্যত্ব মিলেছিল। গুরুঅন্ত প্রাণ ছিলেন। সুধীরলাল তাঁর অবিচল ঈশ্বর।
জনক রোডই যেন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সামনেই রাধু বাবুর দোকান। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বাংলা ছবি এবং গানের জগতের বহু গুণী মানুষের নিয়মিত আড্ডা জমত।
‘চায়ের দোকান’- এর নিখাদ আড্ডা থেকে জন্ম নিয়েছে গানের বীজ। আড্ডা-সিনেমা-গান মিলেমিশে এক হয়েছে বারবার। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে যেন চলত ‘ব্রেন স্টর্মিং সেশন’।
শ্যামল মাত্র মানেই এক ঘুম ভাঙ্গানিয়া কণ্ঠস্বর। কানে গেলেই যাঁর গান সমস্ত মনটা দখল করে নেয়। আলাদা করে মন দিয়ে গান শুনতে হয় না, গানই মন টেনে নেয়।
শ্যামল মিত্র বাঙালির এক আবেগের নাম। তাঁর গানের মতোই তাঁর বেঁচে থাকা। চলে যাওয়াও গান মতোই। আবেশ ছড়িয়ে হঠাৎই ফুরিয়ে যাওয়া। থেমে যাওয়ার নীরবতা আজও বড় নিবিড় হয়ে বাজে না থাকায়...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...