বলুন তো বাঙালির দুর্গাপূজা কীভাবে শুরু হয়? ঠিক বলেছেন বন্ধু, মহালয়ার ভোরে রেডিওতে "মহিষাসুরমর্দিনী" নামের চিরনতুন চিরন্তন ভালোলাগার সেই অবিস্মরণীয় গীতি-আলেখ্য শুনে আমাদের দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়।সারা পৃথিবীর বাঙালির ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। আর মহালয়ার ভোরে যখন আমাদের কানে ভেসে আসে সেই জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর...সেই অপ্রতিম গান...'জাগো তুমি জাগো, জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিনী'.... বিশ্বাস করুন, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।আধুনিক ও জনপ্রিয় বাংলা গানের কিংবদন্তী তিনি। শুধু বাংলাতেই নয়, হিন্দিতেও বহু গান গেয়েছেন। তাঁর সমান জনপ্রিয়তা এপার বাংলা এবং ওপার বাংলায়। তিনি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় - গত সত্তর বছর ধরে যার অসাধারণ জলদগম্ভীর কন্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়েছে বাঙালি তথা ভারতবাসী।
তিনি ছিলেন বাংলা সঙ্গীত জগতের এক অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন
সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে এই জুটি বাঙালি শ্রোতাকে 'শ্যামল বরণী ওগো কন্যা', 'ক্লান্তি নামে গো', 'একদিন ফিরে যাব চলে', 'পল্লবিনী গো সঞ্চারিনী' এবং এইরকম আরো অনেক গান উপহার দিয়েছিলেন। একটা মজার ঘটনা জানানো যাক সলিল চৌধুরী ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে? দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় খুব লম্বা ছিলেন আর সলিল চৌধুরীর উচ্চতা ছিল কম৷ তা নিয়ে সলিল চৌধুরী খুব মজা করতেন। ইডেন গার্ডেনের পাশ থেকে যেতে যেতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে নাকি তিনি বলতেন, "মাথাটা উঁচু করে একটু দেখো তো, স্টেডিয়ামে কোনো খেলা হচ্ছে কি না!’'
বিশিষ্ট সুরকার নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও বন্ধুত্ব ছিল দ্বিজেন বাবুর। নচিকেতা ঘোষের সুরে তাঁর গাওয়া 'একটি দু’টি তারা’, কিংবা সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘এই ছায়া ঘেরা কালো রাতে' ও কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।
হিন্দি ছবিতেও গান গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে জুটি বেঁধে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় হিন্দি গান উপহার দিয়েছেন আমাদের।
সারা জীবনে ১৫০০-এরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন। তার মধ্যে প্রায় ৮০০ গানই রবীন্দ্রসঙ্গীত। ২০১০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত করা হয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। ২০১১ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘বঙ্গবিভূষণ’। এ ছাড়া সাত দশকের বেশি সময়ের সংগীতজীবনে তিনি পেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস মেমোরিয়াল পুরস্কার (১৯৮২), ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার (১৯৯১), রাজীব গান্ধী পুরস্কার (১৯৯২), উত্তম কুমার জীবনকৃতী সম্মান-সহ (২০০২) আরও নানা সম্মাননা। ২০১০ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট পান তিনি।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের গান বিশ্লেষণ করতে গেলে তাঁর গানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়...বেসিক গান, হিন্দি সিনেমায় গান, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত। গানের এই তিন ক্ষেত্রেই স্বাতন্ত্রের ছাপ রেখে তিনি সমান উজ্জ্বল, তবে, শেষ বিচারে একথা বলতেই হয় যে রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন সত্যিই তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
‘এক দিন ফিরে যাব চলে
এ ঘর শূন্য করে
বাঁধন ছিন্ন করে
যদি চাহ যেও ভুলে।...’
সলিল চৌধুরীর লেখা আর সুর করা গানটি গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। এই গানের কথাগুলোর মতোই তিনি সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে অসীম সুরলোকে চলে গেছেন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অতুলনীয় অবিস্মরণীয় গীত-সম্ভার।