মরমী শিল্পী অখিল বন্ধু ঘোষ

শচীন দেব বর্মণের গানের অন্ধ ভক্ত ছিলেন তিনি। বহু বিখ্যাত ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পীর কাছে গান শিখেছিলেন। যদিও শচীন কর্তার কাছে গান শেখেননি তিনি তবুও তাঁদের পাশাপাশি মনে মনে শচীন দেব বর্মণকেও একজন সঙ্গীতগুরু বলেই মনে করতেন। কোন অনুষ্ঠানে গাইতে গেলে কখনও ভুলতেন না গাইতে শচীনকর্তার গান। তাঁর গানে একটা উন্মাদনা ছিল। কী অবলীলায় গাইতেন শচীন কর্তার গানগুলি।

একবার তাঁর নিজের রেকর্ড করা একটি গান ওই শিল্পীর গলায় শুনে শচীন দেব বর্মণ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ওই একই গান সেই গায়ককে নতুন করে রেকর্ড করার অনুমতি দিলেন তিনি। সেই গানটি ছিল, ‘বধূ গো এই মধুমাস...’। সেই শিল্পী তো আনন্দে আত্মহারা। গাইলেন তিনি, রেকর্ড ও বেরোল। বাংলা গানের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। শিল্পী অখিলবন্ধু ঘোষ তাঁর গান দিয়ে স্পর্শ করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম শচীন দেব বর্মণের হৃদয়। শ্রদ্ধাঞ্জলী জানিয়ে ছিলেন তাঁর প্রিয়তম শিল্পীকে।

১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর ভবানীপুরে জন্মেছিলেন দরদী শিল্পী শ্রী অখিল বন্ধু ঘোষ। বাবা শ্রী বামনদাস ঘোষ ও মা শ্রীমতী মণিমালা ঘোষ। ছোটবেলায় খুব লাজুক ছিলেন অখিলবন্ধু। মামা কালিদাস গুহর বাড়িতে, সঙ্গীতের পরিবেশে ছোটবেলা থেকেই গান গাওয়ায় ভারি উৎসাহ তাঁর।

যে কোনো গান শুনেই খুব তাড়াতাড়ি কানে, গলায় তুলে নিতেন, যখন তখন গেয়ে দিতে পারতেন ছোট থেকেই। ১০ বছর বয়সে এক জলসায় তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত "আমি ভয় করব না" এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সংবাদপত্রে সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। মামাবাড়ির উৎসাহে এবং অনুপ্রেরণায় গানের তালিম নিতে শুরু করলেন। প্রথম সঙ্গীতশিক্ষা গুরু নিরাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে।

তারপরে শিক্ষালাভ পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী ও চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। হিন্দুস্তানী ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতে তাঁর শিক্ষা ও দক্ষতা সেই সময়ের বহু বিখ্যাত শিল্পীর তুলনায় বেশি ছিল। পড়াশুনোর থেকে সঙ্গীতের প্রতি টান ছিল অনেক বেশি, তাই ম্যাট্রিকের পরে আর পড়াশুনো না চালিয়ে পুরোপুরি গানের প্রতি মন দিয়েছিলেন।

১৯৪৫ সালে প্রথম আকাশবাণীতে গান গাওয়া শুরু হয়। ১৯৪৭-এ প্রথম রেকর্ড বেরোয়। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের সুরে দু'খানি গান... "একটি কুসুম যবে" (গীতিকার গায়ক স্বয়ং) এবং ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল’। জয়যাত্রা শুরু হয় "গায়ক" অখিলবন্ধু ঘোষের। তাঁর বিখ্যাত গানগুলি যেমন "ও দয়াল বিচার কর" অথবা "তোমার ভুবনে ফুলের মেলা" আজও জনপ্রিয়।


বহু গান গেয়েছেন, নিজের রেকর্ডের অধিকাংশই নিজের সুরে। অথচ এমন দক্ষ, বৈচিত্র্যময় একজন সুরস্রষ্টার সুরে একমাত্র গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়া অন্য শিল্পীরা বেসিক গান রেকর্ড করেননি। মাত্র তিনটি বাংলা ছবিতে নেপথ্য কন্ঠে তাঁর গান অন্য সুরকারদের সুরে। কোনো সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পাননি।

আর এখানেই আমাদের এই সংস্কৃতির ঐতিহ্য যা নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ নেই সেই ঐতিহ্য কোনো অন্ধ প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে যায়। এই অসামান্য শিল্পী এবং স্রষ্টার যথার্থ মূল্যায়ণ কিন্তু হয়নি সেই বাংলাগানের তথাকথিত 'স্বর্ণযুগ' -এর সময়ও। অন্যান্য শিল্পীদের যতটা স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে অখিলবন্ধু ঘোষের মত শিল্পীর প্রাপ্য স্বীকৃতি কিন্তু সেভাবে দেওয়া হয়নি। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্যি।

কত অজস্র দুর্দান্ত সুন্দর সব গান গেয়েছেন, সুর দিয়েছেন, রেকর্ড করেছেন। যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। বেঙ্গল মিউজিক কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেন, সতীর্থরা ছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পূরবী দত্তের মতো দিকপাল শিল্পীরা। অথচ এই অনন্য শিল্পী তাঁর জীবনকালে প্রাপ্য অর্থ, সম্মান, পুরষ্কার সেরকম কিছু পাননি। তবুও মানুষের ভালবাসাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন।

শেষ জীবন বেশ অসুবিধায় কাটান। তাঁর গানের দুটি লাইন - 'সারাটি জীবন কী যে পেলাম, মায়াভরা পৃথিবীতে/ নিয়েছি যত, তারও চেয়ে বেশি হয়তো হয়েছে দিতে'। হয়ত তাঁর সদাহাস্যময় মুখের পিছনে লুকিয়ে থাকত বুকভরা অভিমান। সেই খবর কেউ রাখেনি। সবে জন্মশতবর্ষ অতিক্রান্ত হল এই অনন্য শিল্পীর। এখনো শ্রোতাদের হৃদয়ে রয়েছেন আগেরই মতন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...