আমাদের সুপরিচিত অভিনেতা শ্যাম লাহার একটি অচিরাচরিত ডাকনাম ছিল, যেটি আবার আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। সেই ডাকনামটি হল, 'হুয়া'। শেয়ালের ডাক থেকে উদ্ভুত। কীভাবে উদ্ভূত হল, তাও আসলে এক গল্প।
বৌবাজারের প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে তাঁর জন্ম। ঐতিহাসিক ১৯১১ সালে। তা, সেই সময় বৌবাজার অঞ্চলে রাত্রের দিকে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। হুক্কা হুয়া। ছোট্ট শ্যামচাঁদের (হ্যাঁ, প্রেমচাঁদ স্ট্রিটে জন্ম নেওয়া শ্যাম লাহার পুরো নাম, 'শ্যামচাঁদ লাহা'। প্রেমচাঁদের শ্যামচাঁদ।) ভারি মনে ধরল সেই ডাক। যখন তাঁর আধো আধো কথা বলার বয়স, তখন একদিন এক দূর-আত্মীয়া ভদ্রমহিলা এলেন তাঁদের বাড়ি। কারও বাড়িতে বাচ্চা থাকলে ইচ্ছে বা অনিচ্ছেতে হোক, খোকাটোখা বলে আদিখ্যেতা করে ডেকেটেকে নামধাম জিজ্ঞেস করে আলাপ জমানোই বাঙালি বাড়ির রেওয়াজ। ছোট্ট থেকেই শ্যামচাঁদ গোলগাল নাদুসনুদুস মিষ্টি চেহারার। তাঁকে ভদ্রমহিলার বেশ ভালো লাগল। খুব আদরটাদর করে রীতিমাফিক নাম জিজ্ঞেস করলেন। তখন শ্যামচাঁদ দুম করে বলে বসলেন, 'হুয়া'। ব্যস, অমনি হাসির রোল উঠল। আর তখন থেকেই শ্যামচাঁদকে সবাই 'হুয়া' বলে ডাকতে শুরু করলেন এবং সেটাকে ডাকনাম বানিয়ে ছাড়লেন। শ্যাম লাহা বলতেন যে, নিজের ডাকনাম তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। বাস্তবিকই তাই। এবং, শৈশবে নিজের ডাকনাম নিজে দেওয়া, এও একটা অচিরাচরিত ঘটনা।
বাবা যদুনাথ লাহা দিল্লিতে ভাইসরয়ের অফিসে চাকরি করতেন। ফলে, ছোটবেলাটা তাঁর বাংলার বাইরেই কেটেছে। এতে একটা লাভ হয়েছিল হিন্দি আর উর্দুতে বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর সেটা অভিনয় জীবনে প্রবেশের পক্ষে বেশ কাজের হয়ে উঠেছিল। যাই হোক, ভাষা দখলে এলেও, পড়াশুনোয় তাঁর একেবারেই মন ছিল না। গানবাজনায় তাঁর যত টান। অথচ, সমানে বাবার চাপ, পড়েটড়ে কিছু একটা হতেই হবে! এই চাপের মুখে দিল্লিতে যখন তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন, তখন সেই ১৯২৮-এ, বাবা রিটায়ার হয়ে কলকাতায় এলেন। গানবাজনা-সিনেমা-থিয়েটারের শহরে এসে শ্যামচাঁদ এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সিনেমার শহরে একদিন একটি ঘটনাও ঘটল বেশ সিনেম্যাটিক, এবং সেটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
ঘটনাটা ঘটল পূরবী সিনেমার গায়ে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে। পার্কের সামনে দিয়ে কয়েকজন কিশোরী ছাত্রী স্কুলে যাচ্ছিল। তাদের দেখে পার্কের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি বখাটে ছোঁড়া পিছু নিল এবং উত্যক্ত করতে শুরু করল। ব্যাপারটি চোখে পড়ল অনেকেরই। কিন্তু, এই অসভ্যতা দেখে মাথা গরম হয়ে গেল একমাত্র শ্যামচাঁদের। তবু তিনি শান্তভাবে এগিয়ে এসে বখাটেগুলোকে অসভ্যতামো বন্ধ করতে বললেন। কিন্তু, বখাটেরা তাতে উল্টে তেরিয়া হয়ে রোয়াব দেখিয়ে তাঁকেই মারতে এল। ব্যস, আর যায় কোথায়! গরম মাথা আরও গরম হয়ে গেল। তাঁর গাঁট্টাগোট্টা শরীর নিয়ে এক একটাকে ধরে তুলে আছাড় মারতে শুরু করলেন শ্যামচাঁদ। তখন ছোঁড়ারা পালাবার আর পথ পেল না! শ্যামচাঁদের এই ধোপা-ধোলাই পর্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন বিখ্যাত যন্ত্রশিল্পী তিমিরবরণের দাদা মিহিরবাবু। শ্যামচাঁদকে তাঁর এতটাই ভালো লেগে গেল যে, ধোলাইপর্ব শেষ হতে তিনি নিজে গিয়ে আলাপ করলেন তাঁর সঙ্গে। এবং, যখন জানতে পারলেন যে, শ্যামচাঁদের খুব গানবাজনার শখ, অথচ শেখার কোন উপায় হচ্ছে না; তখন তাঁকে সটান নিয়ে গিয়ে ভিড়িয়ে দিলেন ভাই তিমিরবরণের কাছে।
তিমিরবরণ তাঁকে নিজের হাতে শেখাতে লাগলেন যন্ত্রসঙ্গীত। খুব অল্পদিনেই শ্যামচাঁদ নানান বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। দেশ ও দেশের বাইরে তিমিরবরণের সঙ্গে সঙ্গত করে বাজাবার অধিকারী হলেন। একবার লক্ষ্ণৌতে বেঙ্গলি ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে পাহাড়ী সান্যালের গানের সঙ্গে তবলা বাজালেন শ্যামচাঁদ। গাইতে গাইতে পাহাড়ী শুধুই চেয়ে রইলেন শ্যামচাঁদের মুখের দিকে। বাজাতে বাজাতে শ্যামচাঁদ যে এক্সপ্রেশন দিচ্ছেন, তা শুধু অপূর্বই নয়, অভূতপূর্ব। পাহাড়ী বুঝলেন, লোকটার মধ্যে অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা লুকিয়ে আছে। অনুষ্ঠান শেষ হতেই পাহাড়ী তাঁকে সরাসরি বললেন, আপনি সিনেমায় অভিনয় করছেন না কেন? অভিনয়ে আপনি কিন্তু নাম করবেন। উত্তরে শ্যামচাঁদ জানালেন যে, একে তো অভিনয়ে তাঁর কোন অভিজ্ঞতা নেই; তার ওপর ও লাইনে তাঁর কোন মুরুব্বিও নেই!
মুরুব্বির অভাবে লোকটা একটা চান্স পাবে না! এক মুহূর্ত ভাবলেন পাহাড়ী। তাঁর তখন প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে আলাপ বেশ কিছুদূর গড়িয়েছে, এবং, তাঁরই একটি ছবিতে অভিনয়ের কথাবার্তা চলছে। আর ভাবাভাবি নেই। ঝটপট সেই প্রমথেশের কাছেই একখানা সুপারিশ-চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন শ্যামচাঁদকে। বললেন, ঝাঁপিয়ে পড়তে। ব্যস, হয়ে গেল যোগাযোগ।
প্রমথেশ তখন 'দেবদাস' ছবি করছেন। কাস্টিং কমপ্লিট। তবুও তখন দুই শিল্পীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি এতটাই সম্মানবোধ ও শ্রদ্ধা ছিল যে, শ্যামচাঁদকে ফেরালেন না। তাঁকে একটি মাতালের চরিত্র দিলেন ছবিতে। ছোট্ট অপ্রধান চরিত্র, তবুও এরই মধ্য দিয়ে রুপোলি পর্দায় তাঁর অভিষেক হয়ে গেল। প্রথম বড় রোল পেলেন ১৯৩৫ সালে, 'ভাগ্যচক্র' ছবিতে। ডিটেক্টিভের রোল। তারপর আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হল না।
অভিনয় করতে এসে নামখানাকে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়লেন শ্যামচাঁদ। অনেকেই ঠাট্টা করে 'নদেরচাঁদ', 'ফটিকচাঁদ'-বলে খুব পিছনে লাগতে শুরু করল। সবার লক্ষ্য তাঁর 'চাঁদ'-এ। বুঝলেন, এবার চন্দ্র-বিয়োগের সময় উপস্থিত। সুতরাং, 'চাঁদ' ছেঁটে শ্যামচাঁদ লাহা পর্দায় হয়ে উঠলেন সাদামাঠা, শ্যাম লাহা। এই হচ্ছে চাঁদহীন শ্যামের ইতিহাস।
'ভাগ্যচক্র'-ছবির ব্যাপক সাফল্যের পর চরিত্রাভিনেতা হিসেবে শ্যাম লাহা মাতিয়ে দিলেন একে একে 'যোগাযোগ', 'ইহুদী কী লেড়কী', 'গরবিনী', 'সহধর্মিনী' প্রভৃতি বাংলা ও হিন্দি ছবিতে। পাশাপাশি দাপিয়ে অভিনয় করতে লাগলেন নাটকেও; কখনও 'নাট্যভারতী', কখনও বা 'স্টার' রঙ্গমঞ্চে।
এই পর্বে শ্যাম লাহা শুধুই যে চরিত্রাভিনয় করলেন এমন নয়, নায়ক চরিত্রেও তাঁর আবির্ভাব ঘটল। 'মানিকজোড়', 'লাখ টাকা' প্রভৃতি কমেডি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে তৈরি করলেন নিজস্ব এক কমেডি-ধারা। সেইসঙ্গে আলাভোলা সহজ-সরল অথচ কমিক চরিত্রে তিনি হয়ে উঠলেন পরবর্তীকালের বাংলা ছবির জন্য অপরিহার্য। 'ভানু গোয়েন্দা জহর এসিস্ট্যান্ট', 'সাড়ে চুয়াত্তর', 'দেয়া নেয়া', 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ', 'বসন্ত বিলাপ', 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' প্রভৃতি ছবি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ধারায় তুলসী চক্রবর্তী, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদার, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের পাশে তাঁর নিস্বতায় মোড়া আসনটি চিরকালের আখরে অধিষ্ঠিত।
তথ্যঋণ : 'হুয়াদা'- রবি বসু; 'সোনার দাগ'- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।