"বাজাতে যখন বসি, সামনে সবাই থাকেন বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুধু যন্ত্র আর আমি, আমি আর যন্ত্র, আর কিছু নেই, বাতাসে শুধু প্রেম ভাসছে।" তিনি যখন বাজাতেন তখন যেন ঈশ্বর স্বয়ং নেমে আসতেন মর্ত্যের ধূলিতে। বিভোর মগ্নতা চরাচর স্তব্ধ। চলন শুধু অলৌকিক সঙ্গীতের। সরোদের মিড় থেকে মিড়ে যে মূর্ছনার জন্ম হচ্ছে তা আসলে হৃদয় চিরে বেরিয়ে আসা অনুভূতি কিংবা রিপুর অভিঘাত। রেওয়াজ নয়, সুর থেকে সুরে রাগিনীর সঞ্চারে এ আসলে আত্ম নিবেদন। পন্ডিত রবিশঙ্কর একবার বলেছিলেন, " আলি ভাই হল এক অতি উচ্চস্তরের জিনিয়াস। বাবার তালিম তো আছেই, তার ওপর ওর যে একটা ইন্ডিভিজুয়াল ইমাজিনেশন..."
তিনি শ্রী আলি আকবর খান। নিজের নামের আগে ওস্তাদ, পন্ডিত- এর মতো শব্দগুলো তাঁর ভালো লাগত না। জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার। খ্যব ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে তাঁর কাজের জায়গা মাইহারে চলে যান। বাবা বিখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলি আকবর খান। মা মদিনা বেগম।
বাবার কাছেই ছোটবেলায় নাড়া বাঁধা। প্রথম দিকে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র শিখতেন। শেষ পর্যন্ত থিতু হলেন সরোদে।
বাবা আলাউদ্দিনের কাছে রেওয়াজ চলত ঘন্টার পর ঘন্টা। প্ৰচন্ড কড়া শাসনে। পান থেকে চুন খসার জো ছিল না। একটু এদিক ওদিক হলেই চলত মার।
বাবা যেখানে বসে আলি আকবর কে রেওয়াজ করাতেন সেখানে বসে তিনবার ডাক দিতেন পুত্রকে। তিন ডাকে না এলেই প্রহার! রেওয়াজ-ই জীবন হয়ে উঠেছিল তাঁর। একেবারে রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। শুধু সঙ্গীত নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে রেওয়াজ জরুরি বলে মনে করতেন। যে কোনও কলা চর্চার ক্ষেত্রেই রেওয়াজ ছাড়া প্রকাশ্যে আসা যায় না। একাধিক রাগ তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছিলেন। রাগ সৃষ্টির গল্পগুলোও ভারী অদ্ভুত!
বাবা আলাউদ্দিন তাঁর শিষ্যদের কড়া অনুশাসনে তৈরি করতেন। পুত্রের ক্ষেত্রেও তার অন্যরকম ঘটার প্রশ্নই আসেনা। দিনের পর দিন সেই অনুশাসনের ঝাঁঝ সহ্য করলেও বাবা তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ গুরু। শ্রেষ্ঠ দেবতা। একবার বোম্বাইয়ের এইচএমভি স্টুডিয়োতে একটা রেকর্ডিং-এ এসেছিলেন। এইচএমভির ডিরেক্টর তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, 'আচ্ছা, আপনার বাবা আপনাকে এমন কোনও রাগ শিখিয়েছেন যা আগে কোনওদিন শুনিনি?' কথাটা শুনতে আলি আকবরের খুব একটা ভালো লাগেনি। যেন চ্যালেঞ্জ! তিনি কিছু বললেন না, যন্ত্র হাতে নিয়ে যা মনে এল বাজিয়ে গেলেন। রেকর্ডিং শেষ হতে যোশীজি বাক্যহীন! আলি আকবরকে বললেন, 'এই রাগ একেবারে আমার অচেনা, আগে কখনও কোথাও শুনিনি। নাম কী?' রাগের নাম তো আলি আকবর নিজেও জানেন না। যে রাগ যে তাঁর নিজেরই অচেনা। যোশীজীকে জবাব দেওয়ার জন্য যা মনে এসেছে তাই বাজিয়েছেন।
স্টুডিয়োর বাইরে এসে এক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে রাগের নাম ঠিক করলেন। রাগ- চন্দ্রনন্দন। ছ'মাস পর আর এক কান্ড!একটা প্রোগ্রামে বাজাতে গিয়েছেন, হঠাৎ দর্শকাশন থেকে রিকোয়েস্ট আসছে, ' চন্দ্রনন্দন' আলী আকবর তো ভীষন অবাক! সেটা আবার কী রাগ? সেদিন স্টুডিয়োতে যে রাগের জন্ম দিয়েছিলেন তার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন! শেষ পর্যন্ত নিজের রেকর্ড কিনে সেখান থেকে শিখতে হল নিজের তৈরি রাগ চন্দ্রনন্দন।
তথ্য সূত্র( আমার সময় মাসিক পত্রিকা, প্রতিদিন রোববার(১৯ জুলাই, ২০০৯)