হলুদ রঙের এক বই। লাল অক্ষরে লেখা তার নাম। মলাটে লেখকের ছবিটিও টেনসিলে লাল। প্রথম প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৭। দ্বিতীয় প্রকাশ অগ্রহায়ণ ১৩৬৭। বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী পূর্ণেন্দু রায়। প্রকাশক বীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
বইয়ের নাম ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা।
লেখক শিবরাম চক্রবর্তী।
এই বইয়ে লেখক ‘শিবরাম’ কোনওভাবেই ‘শিব্রাম’ নন। এ বই লেখক শিবরামের আত্মজীবনী। বইয়ের পাতায় পাতায় হয়ে উঠেছেন অন্য মানুষ। শুধুমাত্র হাসির গল্পের লেখক নন, হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন আর কথার পিঠে কথার পান দিয়ে তাঁকে মাপা যায়, বরং এ বই এক দার্শনিকের আত্ম অনুসন্ধান।
পাঠকদের উদ্দ্যেশ্যে কলম ধরের কারণ নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এ আসলে কবর খোঁড়ার মতো। যা লেখক কলম দিয়ে খুঁড়ে চলতে হয়।
কখনও কালজয়ী সাহিত্যের লেখক হতে চাননি তিনি। চেয়েছিলেন সকলের জীবনের সকালের সঙ্গী হতে। হৃদয় জয় করার দায়ও তাঁর নেই শুধু চেয়েছেন সঙ্গী হতে। পাশে পাশে চলতে। ততক্ষণ হাসিহাসি মুখ।
রূপোর ঝিনুক মুখে দিয়ে তাঁর জন্ম হয়নি। কিন্তু রূপের সন্ধান করে গিয়েছেন আজীবন। সেই সন্ধান করতে গিয়েই তাঁর জীবনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল তিনটি শব্দ- ঈশ্বর। পৃথিবী। ভালবাসা।
ছোটবেলায় তাঁর বাড়ি ছিল ‘ঈশ্বরপীড়িত’। ঈশ্বর প্রেমের তিন ধারা মিশেছিল বাড়ির হাওয়ায়। বাবা বৈষ্ণব। মা শাক্ত। আর মামা হরিসাধক।
বাবা শিবরামের মনে হত মহাদেবের মতো। সদাপ্রসন্ন মুখ। গৌরবর্ণ চেহারা। উদাস আপনভোলা এক মানুষ। ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পড়তেন ঘুম থেকে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই বলে যেতেন গীতার লাইন। এক-আধ লাইন নয়, পুরো গীতাটাই। বাবার মুখে শুনে শুনে ছোটবেলাতেই শিবরামের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল গীতা আর উপনিষদের শ্লোক।
তাঁর মায়ের কাছে আসতেন ভৈরবীরা। তাদের পরণে লাল চেলি। হাতে ত্রিশূল। তাঁরা থাকতেনও মাঝে মাঝে। এক ভৈরবী তাঁকে বলতেন ‘তোমার মাকে অমান্য করো না বাবা। জগন্মাতার অংশ রয়েছে তাঁর মধ্যে’।মাকে দুর্গার মতো মনে হত তাঁর।
মা আর বাবার দুই বৈশিষ্ট্য নিয়েই মুখোমুখি হয়েছিলেন পৃথিবীর। ঘর ভুলিয়ে পঠে নামিয়েছিল সে। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তেন ঘর ছেড়ে। ঘুরে বেড়াতেন পথে পথে। পকেটে পয়সা নেই একটাও। কখনও বিনা টিকিটের যাত্রী হয়ে চেপে বসতেন রেলে। লম্বা লম্বা পাড়ি জমত পথে প্রান্তরে। এভাবেই চলে এসেছিলেন কলকাতায়। পেটের দায়ে খবরের কাগজ ফিরি করেছেন। ফুটপাতে-পার্কের বেঞ্চে রাত কেটেছে। জেনেছেন স্বাধীনতা শব্দের মানে। তার জন্য কারাবাসও করতে হয়েছে। এভাবেই গড়ে উঠেছিল শিবরামের পৃথিবী।
আর পথ চলতে চলতে এভাবেই দেখা হয়ে গিয়েছিল ভালবাসার সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘…তার পরিচয় কাউকে চেষ্টা করে পেতে হয় না, সে নিজেই আগ বাড়িয়ে জানান দিয়ে থাকে…’
চলার পথে মোড়ে মোড়ে দেখা হয়ে যায় ভালবাসার সঙ্গে। দেখতে না দেখতেই মরা মানুষকে বাঁচিয়ে দেয় সে। কী করে একজনকে আর এক জনের ভাল লেগে যায় সে এক মহা বিস্ময়!
ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা। এই তিন শব্দের আগলে সারা জীবন কেটেছে শিবরামের। তাই মেসবাড়ির আস্তানা আর খামখেয়ালের ফুটপাত এক হয়েছিল তাঁর কাছে। শব্দে-অক্ষরে-জীবনে-যাপনে জীবনভর ছুঁয়ে গিয়েছেন এই তিন শব্দের দর্শন।
হলুদ মলাটের শিবরামের জীবন মন বদলে দেয় পাঠকের। তখন আর শিবরাম শুধুমাত্র হাসির রসের রাজা শিবরাম থাকেন না, হয়ে ওঠেন দার্শনিক।