তিনি ‘শিব্রাম চক্কোত্তি’ ওরফে শিবরাম

ছোট বেলায় মাস্টারমশাই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ কী হতে চাও?’

উত্তরে ছাত্র বলেছিল ‘স্যার আমি প্যাট্রিয়ট হব’। ছাত্রটি প্যাট্রিয়ট শব্দের মানে জানত না। নেহাত নতুন কানে শোনা শব্দ বলে খাতায় লিখে দেওয়া। কিন্তু শেষপর্যন্ত হলেন লেখক।  

সেই ছাত্রের নাম  শিবরাম  চক্রবর্তী। ওরফে ‘শিব্রাম’।   

‘প্যাট্রিয়ট’ শব্দটি তাঁর পিছু ছাড়েনি। স্কুলে পড়তে পড়তে যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। প্রথমে গান্ধীজীর অহিংস দর্শনের ভক্ত। পরে তাঁর ওপরই এক ইংরেজ আধিকারিককে হত্যার ভার তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু কী করে যেন কী হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত দ্বি-পাক্ষিক হত্যার ঘটনা থেকে অবশ্য রেহাই মেলে। তবে কারাবাস রদ করা যায়নি। জীবনে দু’দুবার জেলে গিয়েছিলেন। একবার স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়ে। অন্যবার ‘যুগান্তর’-এ বিপ্লবী কলম লেখা লেখার জন্য। দ্বিতীয় বারের জেল জীবন বহরমপুর কারাগারে। সেখানে কাজি নজরুল ইসলাম, জিতেন্দ্রলাল বন্দোপাধ্যায়ের মতো মানুষরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয়বারের জেল যাত্রার কাহিনি বেশ হুল্লোড়ে।

বাবার সূত্রে গায়ে রাজ রক্ত গায়ে। কিন্তু আজীবন তিনি গৃহী সন্ন্যাসী। কৌপিন ধারন করেননি বটে, তবে রাজকীয় নির্লিপ্তির বেশ তাঁর চরিত্রের অঙ্গ। তাই মুক্তারামের তক্তার বাইরে আর বেশি কিছু ভাবতে চাননি। খেয়ালখ্যাপা উদাস মানুষ। বাবা-মা দুজনের থেকেই এসেছিল এই উদাস ছন্নছাড়া নির্লিপ্ত, আসক্তিহীন জীবন যাত্রার বীজ। কিন্তু সেই আড়ালটুকু সরালেই বুদবুদিয়ে ওঠে সহজিয়া জীবনবোধের দর্শন। তিনি বারবার বেঁচে থাকার মধ্যে গ্লানিহীন মুক্ত আনন্দের সন্ধান করে গিয়েছেন।

শিবরামের জন্ম কলকাতায় মামার বাড়িতে। ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর।  

 বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী একসময় সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। পরে সংসারে ফিরে বিবাহ করেন। চাঁচোলের রাজ পরিবারের জন্ম হয় শিবরামের।মা ছিলেন তাঁর গুরু।

বাবার পথেই হেঁটেছিলেন শিবরাম। ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিয়ে গৃহত্যাগি হন। চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে চলে এসেছিলে কলকাতায়। তখনও ম্যাট্রিক দেননি।

পরে শিবরাম থাকতেন উত্তর কলকাতার '১৩৪, মুক্তারাম  স্ট্রীটের একটি মেসে। একচিলতে কামরায় তক্তোপোশ জীবন। দু’খানা কম্বল বিছানা। চার দেওয়ালে নাম ঠিকানা  তাঁর কারাবাসের প্রাপ্তি। এক সেট জামা কাপড়। সেটাই পরে থাকতেন একটানা। মেসের তলায় লণ্ড্রীর দোকান। সেটাই ছিল তাঁর ড্রেসিং রুম। নিত্য বেশ বদলাবার বালাই নেই। এক সেট ধুতি জামা পরতে পরতে ময়লা হয়ে গেলে আর এক সেট আসত।

খাওয়া, ঘুম আর সিনেমা। এই তিন বিষয় নিয়ে ছিল তাঁর জীবন। তাঁর নিজের ভাষায়,  "মুক্তারামের মেসে, শুক্তারাম খেয়ে, তক্তারামে শুয়ে" জীবন কাটত তাঁর। মিষ্টির প্রতি তাঁর আসক্তি আর শিবরামের নিজের জবানবন্দিতে সেই গল্প প্রবাদ হয়ে আছে। এ নিয়ে ভারী মজার একটি গল্পও আছে।

শিবরাম তখন স্বদেশী বিপ্লবী। এক পুলিশ অফিসারকে লাগানো হয়েছে তাঁর ওপর নজরদারি করার জন্য। কিছুদিন পর দেখা গেল অফিসার অসম্ভব স্থুলকায় হয়ে গিয়েছেন। আর এর জন্য তিনি সরাসরি দায়ী করলেন শিবরামকে।  ‘শিবরামের পিছনে ধাওয়া করতে গিয়েই নাকি তাঁর এই দশা। শিবরাম বিভিন্ন হোটেল আর দোকানে ঘুরে ঘুরে চপ, কাটলেট, মিষ্টি খান। অনুসরন করতে গিয়ে ভদ্রলোক শিবরামকে অনুকরনও করে ফেলেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে মেদের ভার বইতে হচ্ছে তাঁকে।

মিষ্টির প্রতি তাঁর আসক্তি আর শিবরামের নিজের জবানবন্দিতে সেই গল্প প্রবাদ হয়ে আছে।

 রাবড়ি আর রসগোল্লা দেখলে আর সামলাতে পারতেন না নিজেকে।      

নিজের জীবনে বিশেষ কিছু চাওয়ার ছিলনা তাঁর। অপার আনন্দ ছাড়া। সারা জীবন জুড়ে আনন্দের উৎসের সন্ধান করে গিয়েছেন। খুব প্রয়োজন না হলে টাকা-পয়সার কথা মনে আনতেন না। লেখা শুরু করেছিলেন কাবলিওয়ালার দেনা শোধ করার জন্য। হকারি থেকে সাংবাদিকতা, সওদাগরি অফিসে চাকরি- সব করেছেন। 'ফরোয়ার্ড', 'বিজলি', 'যুগান্তর'- এ সাংবাদিক ছিলেন।

কথার পিঠে কথা, শব্দ নিয়ে জাগলারি ইংরেজিতে যাকে ‘পানিং’ বলে তা ছিল শিবরামের লেখার এক সিগনেচার স্টাইল। আর কোনও লেখকের রস সাহিত্যে এভাবে পানিং এর প্রকরণ আসে নি। শব্দকে সারক্ষণ ভেঙ্গে চুরে অন্য মানে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। প্রখর বুদ্ধি আর দুরন্ত ভাষাজ্ঞান না থাকলে এ সম্ভব হত না। তার সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শন এবং ভাবনার দিকটিও স্পষ্ট। যুগান্তর পত্রিকার লেখা। মস্কো-বনাম পন্ডিচেরিতে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন উঠে এসেছে। তিনি লিখতেন শিশু-কিশোরদের জন্য। নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘আমি কখনই কালজয়ী লেখক হতে চাইনি।এমনকি বিজ্ঞাপন পৃষ্ঠাতেও নয়।’ তাঁর লেখা, ভাবনাচিন্তার যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার বেদনাও হয়ত কোথাও গোপনে প্রচ্ছন্ন ছিল। নিজের সম্বন্ধে কয়েকটি উক্তিতে এমন ভাবনা দানা বাঁধতে বাধত। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি লিখি নিতান্তই টাকার জন্য...আমি ছোটদের লেখক।’  

শিবরামের প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দৈনিক বসুমতীর সম্পাদক হেমন্তপ্রসাদ ঘোষই তাঁকে লেখালেখিতে নিয়ে আসেন। 'ফরোয়ার্ড'  'বসুমতী', 'আনন্দবাজার', 'দেশ'  পত্রিকায় গল্প লেখা শুরু করেন। নিজের লেখা প্রসঙ্গে বলতেন গায়ের জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না, তার বদলে কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার অতোটুকুই।’

লেখক শিবরাম রঙ্গ-তামশার মানুষ। জীবনকেও ইনি সেভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন। বিপন্নতা, যন্ত্রণা ঢাকার এ এক আশ্রয়। আত্মভোলা শিশুর মতো আগলহীন জীবনে আজীবন বাস করে গিয়েছেন। সেখানে কোনও তালা, চাবি, তোরঙ্গ নেই। সবটাই উন্মুক্ত। আলগা। মুক্তোরাম স্ট্রিটের মেসেবাড়ির ঘরের মতোই। 

জীবন তখন শেষ পর্যায়ে স্মৃতিভ্রংশ, কথা অসংলগ্ন  তখনও  ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করলে,  কাঁপা- কাঁপা গলায় উত্তর আসত ‘ফার্স্ট ক্লাস’।  

১৯৮০-র আজকের দিনে (২৮-আগস্ট) তাঁর মৃত্যু হয়।

 

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...