শিবনাথ শাস্ত্রী: সংস্কারকের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক কবি

শিবনাথের তখন দশ কিম্বা এগারো বছর বয়স। বাবার সঙ্গে বউবাজারের জেলেপাড়ায় থাকেন। আর পড়েন বিদ্যাসাগর মশায়ের সংস্কৃত কলেজে। সেখানে তাঁর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে একটি মারাত্মক বড়লোকের ছেলে। বড়লোক, তাই এই বয়সেই তার মনে বিস্তর অহংকার। ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে সে মেশে না এবং পাত্তাও দেয় না। ছেলেটি যে শুধু বড়লোকের ছেলে তা-ই না; সে, যেমন বেঁটে, তেমন মোটা, আর তেমনি মাথামোটা। ফলে, তার নামটি গঙ্গাধর হলেও, ছেলেরা যখন-তখন তাকে 'গঙ্গাধর হাতি' বলে খ্যাপায়। তবু সবার দিন সমান যায় না। বেড়ালের ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে, গঙ্গাধরের ভাগ্যে একবার ছিঁড়ল। গঙ্গাধর ক্লাসের ফার্স্ট হয়ে গেল। অমনি দুম করে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল। সব্বার মুখে চুন পড়ে হাঁ একেবারে পেল্লায় হয়ে গেল। গঙ্গাধর তখন বাঁকা চোখে ঠোঁট বেঁকিয়ে ট্যারা হাসল। আর দেমাক? সেও বাড়ল চোদ্দগুণ। সবাই ভাবল গঙ্গাধরকে বুঝি এবার সমঝে চলতে হবে! কিন্তু, আর সব্বাই যাই ভাবুক, গঙ্গাধরের পাল্লাভারি দেমাক শিবনাথের সহ্য হল না। তিনি ভাবলেন, শিগগির এর একটা জবাব দিতে হবে! কিন্তু, কীভাবে?

'বর্ণপরিচয়' শেষ করার পর থেকে অতি-বাল্যেই মায়ের আবদারে শিবনাথ তাঁকে সুর করে পড়ে শুনিয়েছেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ। পয়ার ও ত্রিপদীর সুর তাতেই জিভ বেয়ে কানে ঢুকেছে, বাসা বেঁধেছে একেবারে গিয়ে মনের অন্দরে। তার ওপর মায়ের ভালো লাগে কবি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা। গাঁয়ে থাকতে মা 'সংবাদ প্রভাকর'-এর পাতা থেকে শিবনাথকে কত্ত শুনিয়েছেন তাঁর কবিতা। কানে শুনে ইতিমধ্যেই তিনি ঈশ্বর গুপ্তের অনুপ্রাস রপ্ত করে ফেলেছেন, আর কবিকে বসিয়ে ফেলেছেন প্রিয়র আসনে। ঈশ্বরের ব্যঙ্গবিদ্রুপমূলক কবিতাগুলো তাঁর কাছে হয়ে উঠেছে অতীব উপাদেয়। এ-সব কথা মনে আসতেই শিবানথের মাথায় হঠাৎ চিড়িক মেরে উঠল হাতিকে ঘায়েল করার চমৎকার ফিকির। কাজটা এর আগে কখনো করেননি, তবু আবেগের বশে আজ সেটা করে ফেললেন। ঈশ্বরের অনুপ্রাস ধার করে লিখে ফেললেন একটি আস্ত ত্রিপদী কবিতা :

"ইজার চাপকান গায়             ইস্কুলে আসে যায়

                   নাম তার গঙ্গাধর হাতি,

বড় তার অহঙ্কার                    ধরা দেখে সরাকার,

                   চলে যেন নবাবের নাতি।"


পরদিন। কবিতাটি হাতে পেয়ে শিবনাথের বন্ধুরা তো উত্তেজনায় যাকে বলে লাফিয়ে উঠল--এ যেন একেবারে মোক্ষম দাওয়াই! স্কুল ছুটি হতেই সমস্ত ক্লাসের ছেলেদের জুটিয়ে গঙ্গাধরকে মধ্যমণি করে বেশ উচ্চৈঃস্বরে কবিতাটি পাঠ করা হল। পাঠ শুরু হতেই গঙ্গাধর বেগতিক বুঝতে পারল। কিন্তু, ভিড়ের মাঝখানে বেকায়দায় পড়ে পালিয়ে যেতে পারল না। কাজেই দাঁড়িয়ে অপমান গিলতে গিলতে তার মুখ লাল হয়ে গেল। কবিতাটি শেষ হতেই যখন ছেলেরা তেড়ে হাততালি দিতে দিতে হো হো করে হাসতে শুরু করল, তখন অপমান সহ্য করতে না-পেরে গঙ্গাধর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। শুধু কাঁদলই না, ইংরেজির মাস্টারমশাই রাধাগোবিন্দ মৈত্র'র কাছে গিয়ে একখানা জবরদস্ত নালিশ ঠুকে দিল। সবাই তখন চুপ। সবার মনেই কি হয়, কি হয়! তখনই মাস্টারমশাই অকুস্থলে এলেন এবং শিবনাথের হাত থেকে কবিতাটি নিলেন। মন দিয়ে পড়লেন। পড়ে কিন্তু শিবনাথকে বকলেন না। মারলেনও না। তার বদলে মাথায় রাখলেন স্নেহসিঞ্চিত হাত। পথ দেখালেন। বললেন, "তোমার কবিতা বেশ হয়েছে, কিন্তু মানুষকে গালাগালি দিয়ে কবিতা লেখা ভালো নয়।" জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখে মাস্টারমশাইয়ের সদ-উপদেশ পেয়ে ঈশ্বরীয় ব্যঙ্গধারাটিকে চট করে শিবনাথ ছাড়তে হয়তো পারলেন না; কিন্তু কাব্যরচনার এক অমোঘ উৎসাহ পেয়ে গেলেন।

ওদিকে ১৮৫৮ সালে একটা ঘটনা ঘটল। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রতি সোমবার 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকা বার করতে শুরু করলেন। দ্বারকানাথ হচ্ছেন শিবনাথের আপন মামা। ফলে, মামার পত্রিকায় ভাগ্নে শুরু করলেন টুকটাক কবিতা লিখতে। আর এই কবিতা লেখার সূত্রেই তিনি পছন্দের পাত্র হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসর প্যারীচরণ সরকারের।প্যারীচরণ 'এডুকেশন গেজেট' পত্রিকার সম্পাদকও। ফলত, এই দুই সম্পাদকের উৎসাহে এই দুই পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে শিবনাথের কাব্যচর্চা চলতে লাগল। লিখতে লাগলেন অবশ্য ছদ্মনামে। এবং, সেটি তাঁরই নামসংক্ষেপ, 'শ্রীশ:'।

ঈশ্বর গুপ্ত যেমন 'সংবাদ প্রভাকর'-এর পাতায় 'কালেজীয় কবিতার যুদ্ধ' ঘোষণা করে ব্যঙ্গরসের বন্যা বইয়ে ছিলেন, তেমনি 'এডুকেশন গেজেট'-এর পাতায় শিবনাথ 'এস এন ডট' ছদ্মনামে ইংরেজ বন্দনার আড়ালে স্বদেশিয়ানার 'চাপান-উতোর' শুরু করলেন। তিনি ইংরেজ বন্দনা করলে, অন্য কোন কবি তার প্রত্যুত্তরে স্বদেশের জয়গান করেন; কিংবা উল্টোটাও চলতে লাগল। ইংরেজ নারীর প্রশংসায় তিনি একবার লিখলেন :

"ধবলাঙ্গী তাম্রকেশী বিড়াল-লোচনা,

বিবাহ করিব সুখে ইংরাজ-ললনা।"

এর উত্তরে কোন কবি লিখলেন দেশীয় নারীর সনাতন সৌন্দর্যের কথা। এভাবে কবিগানের ঢঙে এ-লড়াই চলতে লাগল দিনের পর দিন। এবং, তা হল অসম্ভব জনপ্রিয়। ফলে, 'এডুকেশন গেজেট' ও প্যারীচরণবাবুর কাছে তিনি বেশ খাতিরের লোক হয়ে উঠলেন। তারই জেরে তিনি যাতে পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন, তারই অনুরোধ জানিয়ে কবিখ্যাতি-ইচ্ছুকদের গোছা গোছা কবিতা আসতে লাগল তাঁর হাতে। এভাবেই একদিন এলো নবীনচন্দ্র সেন-নামের এক যুবকের কবিতা, 'কোন এক বিধবা কামিনীর প্রতি'। কবিতাটি পড়ে তাঁর ভালোই লাগল। দুর্বল অংশগুলো তিনি নিজে সংশোধন করে ছাপতে দিলেন। লেখা প্রকাশিত হল 'এডুকেশন গেজেট'-এ।তারপর শিবনাথ নিজে নবীনচন্দ্র সেনকে ডাকিয়ে কাব্যরচনায় প্রভূত উৎসাহ দিলেন। পরবর্তীতে এই নবীনচন্দ্রই 'পলাশীর যুদ্ধ' কাব্য লিখে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন।

তবে শিবনাথের কবিখ্যাতি প্রসারিত হল 'সোমপ্রকাশ'-কে কেন্দ্র করেই। অবশ্য তার মূলে ছিল একটি স্থানীয় ঘটনা। ১৮৬৫-৬৬ সালে ভবানীপুরের একটি সম্ভ্রান্তবংশের ছেলের দ্বীপান্তর হয়। অপরাধ তার গুরুতরই ছিল। শিবনাথ তখন ভবানীপুরের বাসিন্দা। ঘটনাটি নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে খুব আলোড়ন চলল। কিন্তু, শিবনাথকে ভাবিত করল ছেলেটির নির্বাসন-জীবনের একাকিত্বের যন্ত্রণা। তাই নিয়ে লিখে ফেললেন কাব্য :

"আপন পাপের ফল ভোগ করিবারে,

আছি এই জনশূন্য জলের মাঝারে;

নাহি হেথা সুত জায়া সান্ত্বনা করিতে

এহেন বিপদ কালে! নাহি কেহ দিতে

একবিন্দু নেত্র জল আমার রোদনে,

মিশাতে হৃদয় ব্যথা হৃদয় বেদনে।"

'শ্রীশ:' ছদ্মনামে কাব্যটি 'সোমপ্রকাশ'-এ প্রকাশিত হতে লাগল সাপ্তাহিক কিস্তিতে। তারপর তা জনমানসে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করল, এবং তা থেকে কবিমানসে কোন তৃপ্তি সঞ্চিত হল, সে সম্পর্কে শিবনাথ নিজেই বলেছেন: "কয়েকবার প্রকাশিত হইতে না হইতে চারিদিকে সমালোচনা উঠিয়া গেল। পথে ঘাটে, ভাড়াটে গাড়িতে লোকে বলিতে লাগিল, "এ শ্রীশ:' কে হে?" আমার লাঙ্গুল স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল। নিজের মনে-মনে মস্ত একটা কবি হইয়া দাঁড়াইলাম। বাস্তবিক তখন আমার কবিতার মধ্যে একটু নতুনত্ব ছিল। ইহাতে ঈশ্বর গুপ্তের বাঁধা মিত্রাক্ষর অথবা মাইকেলের খোলা অমিত্রাক্ষর ছিল না, কিন্তু দুইয়ের মধ্যস্থলে যাহা তাহাই ছিল। ভাবকে ছন্দের বশবর্তী না করিয়া ছন্দকে ভাবের বশবর্তী করা হইয়াছিল। প্রধানত এই জন্য ইহা তখন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।" 

প্রথম কাব্যটি প্রভূত সমাদৃত হল ঠিকই, কিন্তু কবি শিবনাথ আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেলেন না। ১৮৬৫ থেকেই তিনি ধীরে ধীরে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন, ১৮৬৯-এ এসে ব্রাহ্ম ধর্মে যোগ দিলেন। মূর্তি পূজা ছাড়লেন, পৈতা ত্যাগ করলেন।ব্রাহ্মণ বাবা কিছুতেই তা সহ্য করলেন না। ফলস্বরূপ, বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলেন। ব্যক্তিগত জীবন টালমাটাল হয়ে গেল। ব্রাহ্ম সমাজই হল তাঁর আশ্রয়। সমাজের গুরুদায়িত্ব এল কাঁধে। এ-সময় তিনি এতটাই ধর্মানুরক্ত হয়ে পড়লেন যে, তাঁর লেখাও হয়ে উঠল নিছক ধর্মময় কিম্বা ধর্মতত্ত্বময়। "লেখনি চালনা করিয়াও যদি অর্থোপার্জন করিতে হয়, তাহা হইলেও সেই লেখার ভিতর দিয়া ধর্ম প্রচার করিব।" এই হল তাঁর এসময়ের মনন ও মানসিকতা। তার ফল যা হওয়ার, তাই হল। এই সময়কালের মধ্যে ও পরবর্তী সময়ে তিনি আরও যে চারখানা কাব্য লিখলেন, 'পুষ্পমালা', 'হিমাদ্রী-কুসুম', 'পুষ্পাঞ্জলি' ও 'ছায়াময়ীর পরিণয়' - তারা 'সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ' করার মতো 'সৃষ্টি' হয়ে উঠল না। পরবর্তীকালে রাজনারায়ণ বসু তাই খেদ জানিয়ে লিখেছিলেন, "হায়, কি পরিতাপ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের যাঁতায় পড়িয়া শিবনাথের সাহিত্যিক জীবন খর্ব হইল। এত বড় কবিকে ব্রাহ্মসমাজ মারিয়া ফেলিল।" সত্যিই, সমাজ-সংস্কারক, শিক্ষা-সংস্কারক এবং ধর্ম-সংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রীর আড়ালে বাঙালির কাছে কবি শিবনাথ একেবারেই হারিয়ে গেছেন!



তথ্যঋণ: 'আত্মচরিত', শিবনাথ শাস্ত্রী; 'আত্মচরিত', রাজনারায়ণ বসু, 'নির্বাসিতের বিলাপ' - শিবনাথ শাস্ত্রী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...