তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাচের কাণ্ডারী। দীনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর হয়ে উঠেছিলেন গানেরও ভাণ্ডারী। তখন নতুন গানটি লিখে, সুরটি দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কণ্ঠে সেই গান তুলিয়ে যেন ভারি নিশ্চিন্ত হতেন। গান লিখেই ডাক দিতেন যখন-তখন, আসতে দেরি হলে অভিমান করতেন। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘…আমার গানের সঞ্চয় তোর কাছে আছে—বিশুদ্ধভাবে সে গানের প্রচার করা তোর কাজ।’ গুরুর আদেশ মাথায় নিয়ে সেই কাজ তিনি আজীবন করে গেছেন। ‘তিনি’, শান্তিদেব ঘোষ।
শান্তিদেব আপাদমস্তক শান্তিনিকেতনের। কেননা, বাল্য থেকে তাঁর সুদীর্ঘ জীবন শান্তিনিকেতনে কেটেছে, শান্তিনিকেতনের জন্য কেটেছে। তাঁর এই যে ‘শান্তিদেব’ নাম; এর মূলেও আছে শান্তিনিকেতন। এবং অবশ্যই আছেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। আসলে, শান্তিদেবের পিতা কালীমোহন ঘোষ বঙ্গভঙ্গ যুগের স্বদেশি করা লোক। শান্তিনিকেতন গড়ে ওঠার প্রথম পর্বে এলেন রবীন্দ্রসান্নিধ্যে। বাঁধা পড়লেন আত্মার টানে। যুক্ত হলেন রবীন্দ্রনাথের কর্মযজ্ঞে। কালীমোহনের দেশের বাড়ি পুববাংলার মেঘনার পাড়ে বাজাপ্তি গ্রামে। সেখানেই ১৯১০ সালের ৭ মে জন্ম হল শান্তিদেবের। কালীমোহনের ভিতরে-বাহিরে অন্তরে অন্তরে তখন কেবলই ‘শান্তিনিকেতন’। তাই পুত্রের নামকরণে অন্তরলোকের সেই তীর্থের নামই এসে গেল। নাম দিলেন, ‘শান্তিময়’। সুতরাং শান্তিদেবের পিতৃদত্ত নাম, ‘শান্তিময়’।
শান্তিময়ের বয়স বছর তিন হতে-না-হতেই কবির আহ্বানে কালীমোহন সপরিবারে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা হলেন। কবিগুরুর সান্নিধ্য, শিক্ষায়, ছায়াতলে, বোলপুরের উদার মাঠে, লালপথের দু’ধারের শাল জঙ্গলে, খোয়াইয়ের অবাধ জলে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন শান্তিময়। আশ্রম বিদ্যালয়ে হাজির হতে শুরু করলেন বৃক্ষছায়ার প্রাথমিক শিক্ষার আসরে। পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষাও চলতে লাগল দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে। ক্রমে সেই পাঁচ-ছ’বছর বয়সেই জায়গা হয়ে গেল মাঘোৎসব প্রভৃতি অনুষ্ঠানের গানের দলে। নতুন লেখা গান কবি যখন দীনু ঠাকুরকে শেখান, পেছনে দাঁড়িয়ে শান্তিময়রাও শেখার সুযোগ পেতে লাগলেন। গান শেখার সময় ঘন ঘন মাথা চুলকানোর বদ-অভ্যেস তাঁর। সেটা কবির দৃষ্টি এড়াল না। কবি-কৌতুক হতে তা বঞ্চিতও হল না। ফলে হাসি-খুনসুটির অবিরল স্রোত বইবার অবকাশ পেল। তবে তাতে নির্মলতার অভাব ছিল না বলে, শান্তিময়ের মনে কুণ্ঠা জমবার সুযোগ ঘটল না।
যাই হোক, শেখাতে শেখাতেই রবীন্দ্রনাথ হিরে চিনলেন। তাই শান্তিময়ের সতের-আঠার বছর বয়স হতে-না-হতেই কালীমোহনকে ডেকে একদিন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘একে গানের দিকেই দাও। একজনকে ত ভবিষ্যতের জন্য তৈরী করা দরকার!’তখন কে জানত অল্পবয়সে, অকালে ছ’-সাত বছরের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারী দীনু ঠাকুর মারা যাবেন! রবীন্দ্রনাথও হয়তো কল্পনা করেননি। তবু তিনি এক উত্তরাধিকারীর বর্তমানে আরেক উত্তরাধিকারী তৈরি করে যেতে চেয়েছিলেন। এবং যোগ্য উত্তরসূরিই বেছে নিতে পেরেছিলেন। ফলত ১৯৩৫ সালে অত্যন্ত স্নেহের দীনু মারা যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথের অন্তরে সাময়িক একটা শূন্যতা তৈরি হল বটে, কিন্তু উত্তরাধিকারের ধারাচ্ছেদ ঘটল না। শান্তিময় হয়ে উঠলেন তাঁর গানের দ্বিতীয় ‘ভাণ্ডারী’। আর ইতোমধ্যেই শান্তিময় রবীন্দ্রনাথের হাতে ‘শান্তিদেব’ হয়ে উঠলেন। তিনি তখন বছর বিশের যুবক। নাটক ও গীতিময় এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রাহীদের তালিকা প্রস্তুত করতে বসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তাঁকে এক লহমায় ‘শান্তিময়’ থেকে করে দিলেন ‘শান্তিদেব’। তালিকা থেকেই এই নাম তাঁর পাকা হয়ে উঠল আজীবনের লিপিতটে।
শুধু নাম নয়, বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের খাতও সৃষ্টির বাঁকে বাঁকে বদলে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে কেবল যে গান শেখার সুযোগ হয়েছে শান্তিদেবের এমন নয়, অভিনয়ও শেখার সুযোগ পেয়েছেন। তাকে অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছেন। কেননা, যখনই অবকাশ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ–বাউল প্রভৃতি নানান ধরণের চরিত্রে নামিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্র-মণির স্পর্শে সেই সমস্ত চরিত্রই তিনি সার্থকভাবে রূপায়ণ করে তুলতে পেরেছেন। মাত্র ন’বছর বয়সে ‘শারদোৎসব’ নাটকের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি। ‘বসন্ত’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নেচেছেন। পরে ‘তাসের দেশ’, ‘শ্যামা’, ‘চণ্ডালিকা’ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করে তাঁর প্রশংসাধন্য হয়েছেন।
১৯২৯ সাল নাগাদ আবার মোড় ঘুরল অন্য এক সৃষ্টিশীল অধ্যায়ের দিকে। ঘোরালেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রজীবনে এই অধ্যায় অবশ্য শুরু হয়েছে আরও আগে। ১৯১৮ সাল নাগাদ শিলচরে মণিপুরের গীতিধর্মী নাচ দেখে কবির এত ভালো লাগে যে, সেই নাচের গুরু এনে শান্তিনিকেতনে তা শেখাবার ব্যবস্থা করেন ছেলেদের মধ্যে। অবশ্য এরও কিছুকাল আগে মাদ্রাজ থেকে শান্তিনিকেতনে আসা এক ছাত্রের নাচের অসম্ভব সুন্দর উপস্থাপনা দেখেই ছেলেদের নাচ শেখানোর ইচ্ছে জাগে তাঁর। মণিপুরী নাচের মধ্য দিয়েই তাঁর সেই ইচ্ছে পূর্ণতা পায়।
গুরুদেবের ইচ্ছেয় শান্তিনিকেতনে মেয়েদের নাচের সূত্রপাত হয় গুজরাটি এক মহিলার মাধ্যমে। তাঁর কাছেই গুজরাটি ও গরবা নাচ শেখেন মেয়েরা। শান্তিনিকেতনে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন নাচের আবহ তৈরি হওয়ার পরই রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্য রচনা ও মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করেন। এভাবেই গড়ে ওঠে ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্য। এতদিনের শেখা নৃত্য-আঙ্গিক মিলিয়ে পরিকল্পনা হয় নৃত্যের, অসম্ভব সফলতার সঙ্গে তা মঞ্চস্থ হয়। আর সেই সঙ্গে খুলে যায় রবীন্দ্রসৃষ্টিরথের আরেকটি পথ। গড়ে উঠতে শুরু করে ‘রবীন্দ্রনৃত্যের’ এক সংকর ধারা। এবং তারও কান্ডারী হয়ে ওঠেন শান্তিদেব।
১৯২৯ সালের আগে নাচের দলে কিন্তু শান্তিদেব প্রবেশ করেননি। তবে এই সময় বীরভূমের এক অনুষ্ঠানে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী দলের রায়বেঁশে দেখে রবীন্দ্রনাথের এত ভালো লেগে গেল যে, তাঁদের শান্তিনিকেতনে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিলেন। তাঁরা শান্তিনিকেতনে আসতেই শান্তিদেবের ওপর ভার দিলেন একটি একটি করে তাঁদের সব লোকনৃত্য তুলে নেওয়ার। কবির নির্দেশে শান্তিদেব নাচ শিখতে নেমেই তার ভেতরের আনন্দরসটুকু এমনভাবে আত্মস্থ করে ফেললেন যে, গানের পাশাপাশি নাচও হয়ে উঠল তাঁর অন্তরের ধন।রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই আত্মস্থ করার ক্ষমতা দেখে সুখী হলেন। একে একে মণিপুরী নাচ, দক্ষিণ ভারতের মুখোশ নৃত্য, কেরালার লোকনৃত্য শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। শ্রীলঙ্কায় পাঠালেন ক্যান্ডিদলের নাচ শিখতে।
রবীন্দ্রসান্নিধ্যে শান্তিদেব অনুধাবন করেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ মুদ্রার চেয়ে অভিনয়কে বেশি গুরুত্ব দেন। তাই বিভিন্ন নাচে অভিনয়ের যে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকগুলি রয়েছে, তা আয়ত্ব করে তিনি প্রয়োজনীয় মুদ্রার অলঙ্কারে সাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলির সৃজন শুরু করলেন। গড়ে উঠল গুরুশিষ্যের সমন্বয়ে সৃজনের অনন্য এক অধ্যায়। রবীন্দ্রনৃত্য।
সারাজীবন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টির অনুধ্যানে কাটিয়ে দেওয়া শান্তিদেব অসংখ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত রেকর্ড করেছেন। তাঁর কণ্ঠে রেকর্ডধৃত রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা এক অন্য অভিজ্ঞতা। শুনতে শুনতে তাতে রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুভবের পরশটি যেন টের পাওয়া যায়। উপলব্ধি করা যায় গানের প্রতিটি চরণ আসন তলে বসে শেখার সাধনা। সেই সাধনার বীণেই তাঁর কণ্ঠের মায়ায় সুর ও স্বর হয়ে ওঠে চলমান ছবি। অবিরাম এক ভাবালু আবেশে মুগ্ধ করে রাখে আমাদের। আজও, এখনও, প্রতিটি মুহূর্তে…
তথ্যঋণঃ
‘জীবনের ধ্রুবতারা’- শান্তিদেব ঘোষ।
‘শান্তিদেব ঘোষ’- সন্ধ্যা সেন।