কবিতার বৃন্তমালায় শামসুর রাহমান

হাঁটছেন। পাশাপাশি। কবি ও শিক্ষক অমিয় চক্রবর্তী। কবি ও ছাত্র শামসুর রাহমান। সমমর্মী এই শিক্ষক-ছাত্র দু'জনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁরা হাঁটছেন। অভিন্ন পদক্ষেপে। পাশাপাশি। ফুলবাড়ি স্টেশনের গা-ছোঁয়া রাস্তা ধরে।



পথের ধারে পড়ে আছে পরিত্যক্ত বিবর্ণ ওয়াগন। তায় বাসা বেঁধেছে অসহায়-ছিন্নমুকুল-উদ্বাস্তু বিহারি পরিবার। অমিয়বাবু বললেন, এঁদের নিয়ে তুমিও লেখ, আমিও লিখি। কবিতা। দেখি কারটা ভালো হয়।



অমিয়বাবু লিখলেন। শামসুরও লিখলেন। এক সাহিত্যবাসরে দু'জনেই সেই স্বরচিত কবিতাদ্বয় পাঠ করলেন। শামসুরের রচনা শুনে অমিয়বাবু বিহ্বল হলেন, অভিভূত হলেন। মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, শামসুরের কবিতাটি তাঁর কবিতার চেয়ে অনেকগুণ ভালো একটি সৃষ্টি। সেই সৃষ্টির নাম, 'কয়েকটি দিন ওয়াগনে'।

 

ShamsurRahman1

সঞ্জয় ভট্টাচার্য কবি হিসেবে আজ হয়তো অনেকের কাছে ততটা পরিচিত নন, কিন্তু গত শতকের পাঁচের দশকে তিনি ছিলেন রীতিমতো সুবিখ্যাত। বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতার যথেষ্ট গুণগ্রাহী ছিলেন।



সে-বার বুদ্ধদেব বসু ঠিক করলেন যে, তাঁর 'কবিতা' পত্রিকার সামনের সংখ্যাটিতে সঞ্জয়ের কবিতা দিয়ে শুরু করবেন। ভাবলেন। কবিতা নির্বাচন করলেন। সব ঠিকঠাক। 



এমন সময় শামসুরের দু'খানা কবিতা ডাকযোগে বুদ্ধদেবের 'কবিতা ভবন'-এর ঠিকানায় হাজির হল। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সঞ্জয়ও। কবিতা দুটি পড়া হল। শুনে সঞ্জয়ের এত ভালো লাগল যে, বুদ্ধদেবকে অনুরোধ করলেন, তাঁর কবিতা নয়, শামসুরের কবিতা প্রথমে রেখেই সংখ্যাটি প্রকাশ করতে। তাঁর কথায় বুদ্ধদেবও গুণীকে প্রকৃত স্থান দিলেন। শামসুরের সেই কবিতা দুটির নাম--'তার শয্যার পাশে' এবং 'মনে মনে বলি'।



প্রতিটি ঘটনারই মূলত দুটি অভিমুখ থাকে। উল্লিখিত ঘটনা দুটিরও তাই রয়েছে:



প্রথমত, ঘটনা দুটি ব্যক্ত করে যে, বাংলা কাব্যজগতে শামসুর রাহমানের আবির্ভাবই ঘটেছিল একজন পূর্ণ শক্তিমান কবি হিসেবে। নইলে অমিয় চক্রবর্তী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব বসুর মতো বিদগ্ধ কবিদের প্রশ্রয় তিনি পেতেন না। 



দ্বিতীয়ত, উল্লিখিত কবিরা যখন উজ্জ্বল নক্ষত্র, তখন তাঁরা একজন নতুন কবির ভালো কবিতাকে মুক্তকণ্ঠে ভালো বলছেন, তাকে নিজেদের কবিতার ঊর্ধে স্থান দিচ্ছেন, কবিকে যোগ্য জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন--এই উদারতা বড় দুর্লভ ছিল তৎকাল ও পরবর্তীকালে। শামসুর তাঁদের কাছ থেকে এই উদারতার শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং তা আজীবন পালন করেছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠা পাবার পর শেষ দিন পর্যন্ত নতুন কবিদের কবিতা আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করেছেন। ভালোকে ভালো বলেছেন, কবিকে উৎসাহ দিয়েছেন, সকলের কাছে মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। আসলে, কবিতার প্রতি তাঁর হৃদয়ে আমূল ভালোবাসা ছিল। আর, সেটা আজীবন ছিল।

 

ShamsurRahman2

কবিতার প্রতি এই যে তাঁর ভালোবাসা, তার পূর্বে সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জেগেছিল। আর সেটা জেগেছিল বিষাদতাড়িত এক আবেগমুক্তির যাতনায়। সেও এক ঘটনা:



অনেকগুলি ভাইবোনের পরে শামসুর। শামসুরের পরে ছিল ছোট্ট এক বোন। 



শামসুর যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন সেই বোনের বয়স সবে এক বছর। খেলানো, কোলেপিঠে নেওয়া সব মিলিয়ে সুন্দর আনন্দের আবহে দু'জনের মধ্যে সমৃদ্ধ হতে লাগল স্নেহ-ভালোবাসার পরত। সেই ভালোবাসায় আঘাত এল বোনটির হঠাৎ যখন বসন্ত হল। গুটি বসন্ত। এ-বসন্তে তখন বড় কেউ বাঁচত না। বোনটিও তার কচি শরীরে সেই বসন্তের দুঃসহ যাতনা সহ্য করতে পারল না, মারা গেল। 



বলা বাহুল্য, প্রিয় সহোদরাকে এভাবে হারিয়ে অন্তরে এক নিদারুণ শোক এল শামসুরের। মনে হল, সেই শোক প্রকাশ করতে না-পারলে তিনিও বাঁচবেন না। তখন 'ছিন্নমুকুল' নামে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পাঠ্য একটি কবিতার অনুকরণে অন্তর উজাড় করা শোকে রচনা করলেন একটি গদ্য। সেই গদ্য যদি সাহিত্য হয়ে থাকে, তাহলে এটিই ছিল তাঁর রচিত প্রথম সাহিত্য।



তারপর না গদ্য, না পদ্য কিছুই লেখেননি দীর্ঘকাল। অবশ্য লেখার মতো আবেগঘন কালও আর আসেনি। তাছাড়া বাবা লেখালেখি তেমন পছন্দও করতেন না। কারণ, বাবা তাঁর এক সাহিত্যিকবন্ধুকে যক্ষ্মা রোগে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে মরতে দেখেছিলেন, তাই।



তবু, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; তখন দেশভাগ, উদ্বাস্তু-যাতনা, ভাষা ও ধর্মীয় আগ্রাসনের অন্ধকারকালে নিজেকে সামলাতে পারলেন না, অবধারিতভাবে আবার আবেগরুদ্ধ হলেন। আবারও নিজেকে প্রকাশের আকুলতা অনুভব করলেন। এবার তা প্রকাশিত হল পদ্যে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে লিখলেন, 'উনিশ শো ঊনপঞ্চাশ' নামের কবিতাটি। বন্ধু হামিদুর রহমানের অসম্ভব ভালো লাগল সেটি। মূলত তাঁরই তাড়নায় নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত "সোনার বাংলা" পত্রিকার দপ্তরে প্রকাশের জন্য শামসুর কবিতাটি জমা দিলেন। পরের সংখ্যায় কবিতাটি পত্রিকায় জায়গা করে নিল। এবং, এভাবেই এক অস্থির সময়ে কবি শামসুর রাহমানের আত্মপ্রকাশ ঘটল।



শামসুর শুধু অস্থির সময়ে আত্মপ্রকাশ করলেন না, হয়ে উঠলেন সেই সময়ের প্রতিনিধি, সেই সময়ের কথকঠাকুর। সেই কথকতায় শোনা যায় বার বার তাঁর শুভ-আত্মার ধ্বনি, শান্তি-শুভ্র প্রার্থনা:

"আর পারি না, দাও ছড়িয়ে পদ্মকেশর

বাংলাদেশে।

ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি 

লাশ নেবো না।

...     ...     ...    ...    ...

শিউলি ফোটা সকাল নেবো!"

("ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা" কাব্য ও কবিতা)।



সহজ ভাষায়, সহজ চিত্রকল্পে, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে রচিত হয়েছে তাঁর কবিতা। কবিতাকে তিনি অসাধারণ ভাবনমালায় সাজিয়ে সাধারণের মতো করে সাধারণের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। দিয়েওছেন সেভাবেই। তাই এপার-ওপার দুই পারের ইছামতীর পানি, পদ্মার ঢেউ আর তারকাঁটার সুতীক্ষ্ণ ফলা পেরিয়ে আবহমান বাংলা সাহিত্যের আপামরের কবি হয়ে হৃদয়নন্দনে নন্দিত তিনি, তাঁর কবিতা, তাঁর উচ্চারণ, আখরমালা...



তথ্যঋণ: ১৯৯৬ সালে আবুল আহসান চৌধুরী গৃহীত শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...