শামসুর রহমান ফারুকি

'মালুম ক্যায়া কিসি কো মেরা হাল-ই - জার হ্যায়'

মাত্র সাত বছরের এক বালক এই ছত্রটি লিখেছিল। সকাল দিনের সূচক। পরবর্তীতে তিনি হলেন  উর্দু সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব শামসুর রহমান ফারুকি।

১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে পরাধীন ভারতের আজমগড়ে ফারুকি জন্মগ্রহণ করেন।

 আজমগড়ে জন্ম হলেও ফারুকি-র বেড়ে ওঠা গোরখপুরে। সেখানকার মহারাজা প্রতাপ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করার পর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।

রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারে পিতার কড়া শাসনে বড়ো হয়ে ওঠা ফারুকি নিজেও নিয়ম মেনে চলার পন্থী ছিলেন। তিনি  একবার বলেছিলেন তাঁর এই ধর্মীয় পশ্চাৎপট তাঁকে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রতি বিশ্বস্ত হতে দেয়নি।

      মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন। এই সময়েই তিনি তাঁর বোনের সঙ্গে ‘গুলিস্তান'  নামে একটি পারিবারিক পত্রিকা শুরু করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কবিতা লিখেছেন।

১৯৬০ সালে ফারুকি ইন্ডিয়ান পোস্টাল সার্ভিসে যোগ দেন। দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে পোস্ট মাস্টার জেনারেল এবং পোস্টাল সার্ভিসেস বোর্ডের সদস্য হয়ে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনের পাশাপাশি ১৯৬৬ সাল থেকে তিনি ‘শাবখুন’ নামে একটি  উর্দু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন।

 দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় প্রকাশিত এই পত্রিকার ফারুকি নিজে ছিলেন সম্পাদক ও প্রকাশক দুই-ই। তিনি অধ্যাপনাও করেছেন। পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া রিজিওনাল স্টাডিস সেন্টারে তিনি ছিলেন ‘ভিজিটিং প্রফেসর’।

      ফারুকিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে বর্ণনা করা যায় না। তিনি কবি, কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, তিনি অনুবাদক, শিক্ষাবিদ, সমালোচক, সম্পাদক আরও কত কী!

  উর্দু সাহিত্য সমালোচনায় আধুনিকতম পাশ্চাত্য সমালোচনা রীতির প্রয়োগ তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।  উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর সুগভীর জ্ঞান এবং বিশ্লেষণধর্মী স্ংবেদনশীল মনন তাঁর কাজগুলিকে আঞ্চলিক ভাষাসাহিত্যের সীমানায় আবদ্ধ করে রাখেনি। অনুবাদক হিসেবে ও তিনি ছিলেন অনবদ্য।‘ 'কাহি চান্দ থে সার-এ আসমান’ উপন্যাসটি ফারুকি ২০১৩ সালে ' দ্য‌ মিরর অফ বিউটি’ নামে অনুবাদ করেছিলেন।

      উর্দু সাহিত্যের দুই প্রবাদপ্রতিম কবি গালিব এবং মীর তকি মীর-কে নিয়ে ফারুকি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। সাহিত্য সমালোচনায় ফারুকি সর্বতোভাবে নতুন পথের পথিক।  উর্দু সাহিত্যের ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাস বিষয়ে ফারুকি পথপ্রদর্শকের কাজ করেছেন।  উর্দু ভাষা বিষয়ে নানা ভুল ধারণা তিনি খন্ডন করেছিলেন। তাঁর কাছে এই ভাষা ছিল এক মহৎ সভ্যতার মূর্ত রূপ। জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর কবির কলম সচল ছিল। ফারুকির একাধিক গল্পসঙ্কলনের অন্যতম সাভার আউর দুসরে আফসানায়(দ্য রাইডার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ), গম্জ-ই-সোখ্তা(বার্নড ট্রেজার),সব্জ আন্দার সব্জ(গ্রিন ইনসাইড গ্রিন), মজলিশ-ই-আফাক মে পারভানা সান:কুলিয়াত (লাইক আ মথ ইন আ কনগ্রেগাশন অফ ওয়েলকিন: কালেক্টেড ওয়ার্কস) ইত্যাদি।  উর্দু সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য তিনি সরস্বতী সম্মান ও পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন।

     ফারুকি সম্পাদিত ‘শাবখুন'-এ লিখেছেন  আলি সরদার জাফরি, ইসমত চুঘতাই, রাজিন্দার সিং বেদি-র মতো প্রগতিশীল লেখকেরা । তাঁর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘দাস্তানগোই’ যা কিনা  উর্দু মৌখিক সাহিত্যের এক বিশেষ ধারা সে বিষয়ে চর্চা ও সংরক্ষণ।  দাস্তানগো অর্থাৎ গল্প কথক  এবং ক্যালিওগ্রাফারদের সামনে বসিয়ে তিনি দাস্তানগোই সংগ্রহ করেছিলেন। এলাহাবাদে তাঁর বাড়ির লাইব্রেরিতে ৪৬ খন্ডের  উর্দু মৌখিক রোমান্স কাহিনি ‘দাস্তান-এ-আমির হামজা’ আছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন স্নেহশীল স্বামী ও পিতা। তাঁর সাহিত্য চর্চায় স্ত্রীর অবদান তিনি মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। তাঁর দুই কন্যাই উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপিকা। তাঁদের স্মৃতিচারণে ফুটে ওঠে দায়িত্বশীল পিতার পাশাপাশি এক কঠোর অধ্যাপক ও পথপ্রদর্শকের ছবি।

      বেশ কিছু বছর আগে ফারুকি একবার বলেছিলেন প্রথম জীবনে শেক্সপিয়র, হার্ডি ও পাশ্চাত্য লেখকদের এবং গালিবের দ্বারা তিনি প্রভাবিত ছিলেন। মধ্যবয়েসেও গালিব, ইকবাল এবং পাশ্চাত্য কবিলেখকেরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু চল্লিশ বছরের পর মীর, ইকবাল, সবক-ই-হিন্দি ফারসি কবিরা, অষ্টাদশ শতকের একাধিক  উর্দু কবি এবং গালিবই তাঁর সঙ্গী। ২০২০র ডিসেম্বরের ২৫-এ ৮৫ বছরের কর্মময় জীবনের শেষ অবধি এঁরাই ছিলেন শামসুর রহমান ফারুকি -র নিবিড় আশ্রয়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...