গল্প একটাই। কিন্তু সেটা নিয়ে যে চমৎকার একখানা ছবি হতে পারে, সে-কথা একই সঙ্গে ভাবছেন অনেকেই। সিনেমা-সাহিত্যের দপ্তরে এমন ঘটনা আকছার ঘটে না। ১৯৫৬'র "প্রসাদ" পত্রিকায় শক্তিপদ রাজগুরু'র লেখা 'চেনামুখ' গল্পটির ক্ষেত্রে কিন্তু সেই বিরল ঘটনাটি ঘটেছিল।
গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটি মেয়ে। নীতা। সামাজিক-পারিবারিক স্বার্থপরতার মাঝে সে এক সকরুণ স্বার্থত্যাগী মেয়ে। সে ছিন্নমুকুল, তার পরিবারটি ছিন্নমূল।
"প্রসাদ" পত্রিকায় গল্পটি পড়তে পড়তে অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী তো হতবাক। এ তো গল্প নয় নিছক, এ যে তাঁর ব্যক্তিজীবনেরই আলেখ্য! বার্মা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে খিদে-তেষ্টা আর অভাব নিয়ে কলকাতায় আসা, পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া, বোনদের বিয়ে দেওয়া, পরিবারের জন্য সমস্ত স্বার্থ ত্যাগ করেও দোষী হওয়া-এ তো তাঁর জীবনের জাজ্বল্যমান সত্যি! গল্পের নীতার যা নিয়তি, বাস্তবে তাঁরও যে তাই! সিনেমার মতোই ফ্ল্যাশব্যাক এসে সাহিত্য ও জীবনকে যেন মিলিয়ে দিল লহমায়। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ করে দিল সুপ্রিয়াকে।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস খানিক সহজ করল মানুষটাকে। সেই সঙ্গে ভেতরের অভিনেত্রী-সত্তাটি বলে উঠল, ইস, গল্পটি নিয়ে যদি ফিল্ম হত, আর নীতার চরিত্রে যদি অভিনয় করার সুযোগ পেতাম, তাহলে জীবনটা সার্থক হয়ে যেত! শুনে অলক্ষ্যে নিয়তি হাসলেন!
অন্যদিকে পত্রিকায় গল্পটি পাঠ করে আপ্লুত হলেন আর-একজন। তিনি চিত্রগ্রাহক (পরবর্তীকালে চিত্রপরিচালকও) দীনেন গুপ্ত। গল্পে সমসাময়িক সমস্যা, মনস্তত্ত্বের প্রবাহ, পারিবারিক শোষণের মধ্যে সামাজিক প্রতিচ্ছবি পেয়ে তিনি যাকে বলে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সিনেমার মানুষ, সিনেমার দৃষ্টিকোণ থেকেই মুগ্ধ হলেন। ভাবলেন, বাহ, গল্পটা দিয়ে বেশ একখানা ছবি বানানো যায় তো!
তখন দীনেন গুপ্ত পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটকের ছবিতে চিত্রগ্রাহক হিসেবে অসাধারণ কাজ করছেন। 'অযান্ত্রিক' ছবিতে কাজ করা হয়ে গেছে। 'বাড়ি থেকে পালিয়ে' নামে একটি ছবির কাজ চলছে। ঋত্বিকের সঙ্গে কাজ করতে করতে বুঝেছেন, সেলুলয়েডে গল্পটার সঙ্গে জাস্টিস করতে যদি কেউ পারেন, তাহলে ঋত্বিকই পারবেন। সুতরাং, অবিলম্বে গল্পটি তুলে দিলেন তিনি ঋত্বিকের হাতে।
'চেনামুখ' গল্পটি পড়ে ঋত্বিক এক অসাধারণ সিনেমার সম্ভাবনা তো দেখলেনই, সেই সঙ্গে উদ্বাস্তু জীবনের প্রতি লেখকের সত্যনিষ্ঠা দেখে আরও মুগ্ধ হলেন।
আসলে, পূর্ববঙ্গের রাজশাহীতে জন্ম নেওয়া বড় হওয়া ঋত্বিকও তো ক'বছর আগেই দেশভাগের ফলে তাঁর জন্মভূমিকে চিরতরে বিদেশ হয়ে যেতে দেখেছেন। জন্মভূমির সঙ্গে বিচ্ছেদের এই যন্ত্রণা তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি। ছিন্নমূল মানুষের শরিক তিনি। তাই তাদের বেদনা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে সংপৃক্ত। তার ওপর এ-গল্পের নীতার মধ্যে তিনি তাঁর দর্শনের 'গ্রেট মাদার'কেও পেয়ে গেলেন। যে মা সন্তানের কলুষ-ক্ষুধা-বেদনা সমস্ত অঙ্গে ধারণ করে নিজেকে শেষ করেও সন্তানের মুখে হাসি ফোটায়। সেই মাকে। ফলে, তিনি প্রস্তুত হলেন গল্পটি থেকে ছবি তৈরির জন্য। 'চেনামুখ' অবলম্বনে যার নাম দিলেন, 'মেঘে ঢাকা তারা'।
'চেনামুখ' গল্পের লেখক শক্তিপদ রাজগুরু অবশ্য উদ্ধাস্তু মানুষ ছিলেন না। তবে জন্মভূমি থেকে বিচ্ছেদের বেদনা তাঁরও ছিল। বাঁকুড়ার গোপবন্দি গ্রামে ছিল শক্তিপদর সাতপুরুষের বাড়ি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের পয়লা ফেব্রুয়ারি সেখানেই তাঁর জন্ম হয়েছিল।
কিন্তু জ্ঞানগম্যি হতে-না-হতেই শক্তিপদকে গ্রামছাড়া হতে হল। বাবার বদলির চাকরি। বদলি নিয়ে তিনি হলেন মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপির পোস্টমাস্টার। ফলে, গ্রাম ছেড়ে মায়ের সঙ্গে বাবার কাছে গিয়েই থাকতে হল। মাঝে মাঝেই গোপবন্দির শৈশবস্মৃতি পীড়া দিতে লাগল। তারপর সে-সব ছাড়িয়ে পাঁচথুপির ত্রৈলোক্যনাথ ইনস্টিটিউশন থেকে একদিন মেট্রিক পাশ করে কলকাতায় এলেন কলেজে পড়তে। শুরু হল কলকাতার সঙ্গে আলাপ।
আলাপ চলাকালেই বাবা মারা গেলেন হঠাৎ। অকালে কাঁধে নামল সংসারের দায়ভার। তারই মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ দেখলেন, কলকাতার রাস্তায় 'ফ্যান দাও' আর্তনাদে মুখর বুভুক্ষু মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখলেন, কালোবাজারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখলেন, দেশভাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা দেখলেন, ছিন্নমূল মানুষের স্রোত দেখলেন, তাদের অনিশ্চিত জীবনের প্রবাহ দেখলেন! আর এই দর্শনের ধারাভাষ্য নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প 'আবর্তন' "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গেল। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়ে গেল প্রথম উপন্যাস "দিনগুলি মোর"। তারপর প্রকাশিত হয়ে চলল আরও গল্প, আরও উপন্যাস।
এরই মাঝে বন্ধুর ছেলের চিকিৎসার জন্য ধার নেওয়া পাঁচশো টাকা শোধ করতে একখানা গল্প লেখার প্রয়োজন পড়ল 'প্রসাদ' পত্রিকায়। গল্প লিখলেন। তাতে দুটো অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
প্রথম অভিজ্ঞতা বেলেঘাটার ভাড়াবাড়ির। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন; সেখানে সত্যিই নীতাকে দেখেছিলেন তিনি। সেই নীতার হয়তো অন্য কোন নাম ছিল। কিন্তু গল্পের নীতার মতোই বাবা-মা ও গাইয়ে হবার স্বপ্ন দেখা উদাসীন দাদার জন্য সে নিজের সমস্ত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সংসারের সমস্ত দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। আর সকলের চোখে হারিয়েছিল নিজের জীবনের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা, কলকাতা ও শহরতলির উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে দীর্ঘদিন শক্তিপদর যাতায়াত এবং বসবাসের বিনিময়ে অর্জিত অভিজ্ঞতা।
ওই দুই বাস্তব অভিজ্ঞতা শিল্পীমনের কল্পনায় জারিত হয়ে 'চেনামুখ'কে সত্যিই হয়ে করে তুলেছিল বিপন্ন সব চেনামুখের দর্পণ। যে-মুখকে এই দর্পণ থেকে চিনে তার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়ে উদ্বেলিত হয়েছিলেন সুপ্রিয়া, দীনেন, ঋত্বিক এবং আরও অনেকে।
তারপর একে একে আশ্চর্য যোগাযোগ। ঋত্বিক শক্তিপদর সঙ্গে দেখা করলেন। কপিরাইট নিয়ে চিত্রনাট্য লিখলেন। নানান অঘটন পেরিয়ে সোজা গেলেন সুপ্রিয়ার কাছে। অফার করলেন নীতা চরিত্রটি। সুপ্রিয়া আবারও হতবাক হলেন! স্বপ্ন এবং বাস্তব এভাবে কাকতালীয়ভাবে মিলে যাবে, এ ছিল তাঁর কল্পনারও অতীত। ফলে, তিনি যে কাজটা করতে রাজি, সেটা জানাতে বিন্দুমাত্র দেরি করলেন না। তারপর আর কী, ছবিটা হয়ে গেল। তৈরি হল ইতিহাস।
এভাবেই অনেকগুলো ছিন্নমূল আর ছিন্নমুকুল মনকে বেঁধে ক্লাসিকের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব কিন্তু লেখক শক্তিপদ রাজগুরুরই। প্রায় দেড়শ উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। কথাকার হিসেবে তাঁর বিষয়বৈচিত্র্য অসাধারণ। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য, শতবর্ষ পেরিয়ে আজও তিনি ততটা আলোচিত নন। কিন্তু ইতিহাস জানে, 'তবু বিহঙ্গ' ও 'কেহ ফেরে নাই'-এর মতো উপন্যাসের জনক এই মানুষটি বাংলা সাহিত্যধারায় ছিন্নমূল মানুষের জীবন-মহাকাব্যের এক ক্লাসিক চিত্রকর...