মেঘে ঢাকা তারা-র জন্মদিনে
‘পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ভেসে এল বুকফাটা চিৎকার, ‘দাদা,আমি বাঁচতে চাই... ‘।
দাদার কাঁধ জড়িয়ে বোনের চাপা কান্না তখন জলপ্রপাত
তাঁর লেখনীতে ছিল সারেঙ্গীর সুরে কান্নার গুঞ্জন।তিনি শক্তিপদ রাজগুরু। বাংলা সাহিত্যের তারা খসা ঔপন্যাসিক।
বাংলায় তাঁর লেখা উপন্যাসের সংখ্যা শতাধিক। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সাতটি গল্প প্রাণ পেয়েছে চলচ্চিত্রে।
১৯২২ সালের পয়লা ফ্রেব্রুয়ারি জন্ম বাঁকুড়া জেলার গোপবন্দি গ্রামে । ছোট থেকেই অসাধারণ মেধাবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বড় কবিতাগুলি অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারতেন।
মুর্শিদাবাদের পাঁচথুপি টি এন ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। উচ্চশিক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । পড়াশুনোর পাশাপাশি ছিল ভ্রমণ এর নেশা। বাইরের ডাক পেলেই হল, রইল ঝোলা, চলল ভোলা । ছোটোনাগপুরের জঙ্গল, দণ্ডকারণ্যের সবুজভূমি তাঁকে বরাবর টানত ।তারাই ছিল অবসরের ঠিকানা।
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘দিনগুলি মোর’। বিষয়বস্ত উদ্বাস্তুদের বারোমাস্যা ।
বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখনীর অনুপ্রেরক। প্রাপ্ত মনস্ক মানসিক ও সাংসারিক জটিলতা ছিল অধিকাংশ লেখার মূল আধার।
ভোলেননি শিশু-কিশোরদের কথাও । সৃষ্টি হল পটলা চরিত্রের । তাঁর বিশ্বাস, বয়স জীবনে আনে জটিলতা। সেই জটিল সুতোর পরত সাজাতে গেলে চাই একটি শিশু মন।
উল্টোরথ পত্রিকায় ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় বড়গল্প চেনামুখ । উদ্বাস্তুদের অসহনীয় জীবন সংগ্রাম যেই গল্পের আখ্যান। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক এই গল্পের কাহিনী অবলম্বনেই তৈরী করেন মেঘে ঢাকা তারা।যা আজও বিশ্ব চলচ্চিত্রে কিংবদন্তী।
রাজগুরু বিদিত হন জনসাধারণ্যে । ঋত্বিক ঘটকের প্রশিক্ষণে এ চলচ্চিতের চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শক্তিপদ নিজেই। শক্তিপদ রাজগুরুর লেখাগুলি হিন্দি, তামিল, মলয়ালম ও মারাঠি ভাষায়ও অনূদিত ও সমাদৃত।
এমনকি মঞ্চ ও টেলিভিশনেও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর রচনা অবলম্বনে তৈরি নাটক ও টেলি সিরিয়াল। তিনি নিজেও চিত্রনাট্য লেখক হিসেবেও হন প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য মেঘে ঢাকা তারা, মণি বেগম, অন্তরে অন্তরে, জীবন কাহিনি, অনুসন্ধান, অমানুষ, বাঘিনী ও কুয়াশা যখন।
সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর অভিনব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন । সাহিত্যে বিশেষ কীর্তির জন্য বিভূতিভূষণ পদক, অমানুষ ছবির চিত্রনাট্যের জন্য অল ইন্ডিয়া লায়ন'স অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৯ সালে হল অফ ফেম সাহিত্যব্রহ্ম শিরোপায় ভূষিত হন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে বঙ্গ বিভূষণ সম্মান সেই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৪ সালে হৃদ রোগ কেড়ে নিয়েছিল এই অসামান্য প্রতিভাকে।
তবুও অসামান্য এই সাহিত্যিকের মহাপ্রয়ানে কান্না শোনা যায়নি সাহিত্য জগতের। মিডিয়াও সেভাবে তাঁকে নিয়ে পর্যালোচনা করতে উদ্যোগী হয় নি। কারণ? একরকম উদাসীনতা! যে ভাবে পরম্পরাগতভাবে ইতিহাস ভুলে যেতে অভ্যস্থ বাঙালি।
জীবনের উপপ্রান্ত পৌঁছে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাংলা সাহিত্যকে আমি কী দিতে পেরেছি জানি না, কিন্তু যদি কিছু দিয়ে থাকি তা আমার সত্য অনুভব। আমি যা, যতটুকু, সেটুকুই থেকেছি, ইতিহাস সৃষ্টি করার ভান করিনি।