চেনা-ছকের বাইরে বিজ্ঞানী ও মানুষ সত্যেন্দ্রনাথ বসু

ছয় বোনের কোলে একমাত্র ভাই। সত্যেন্দ্রনাথ। তাই তিনি বোনদের নয়নের মণি তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে বাড়ির সকলের কাছেও ছিলেন বড় আদরের। চেহারাটিও ছিল বেশ গোলগাল, আর অসম্ভব মিষ্টি। তাছাড়া সত্যেন্দ্রনাথেরও ছোট থেকেই দারুণ একটি গুণপনা ছিল। সেটি হচ্ছে, অচেনা অপরিচিত মানুষকেও লহমায় আপন করে নেওয়ার গুণ। তার ফলে, বাইরের মানুষের আদরও জুটত খুব।

আর-পাঁচজন আদুরে ছেলে বাল্যকালে যেমন দুরন্তপনা করে থাকে, সত্যেন্দ্রনাথ ঠিক তেমনই দুরন্ত ছিলেন। কিন্তু তার বাইরে আর-পাঁচজনের সঙ্গে তাঁর তেমন কোন মিলই ছিল না। সেই পাঁচজনের মতো খেলাধুলোর প্রতি তাঁর একেবারেই আসক্তি ছিল না।

সাধারণ ছেলেরা যে বয়সে গণিতকে পাতকুয়োয় পাঠিয়ে আনন্দ পেত, তিনি সেই অল্পবয়স-কল্পবয়সেই অঙ্ক কষতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। অঙ্ক অঙ্ক অঙ্ক। সেটাই ছিল তাঁর খেলা। বাবা নিত্যদিন কাজে যাবার আগে মেঝের ওপর খড়ির আঁকে রাশি রাশি যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের সমস্যা লিখে দিয়ে যেতেন। আর সত্যেন্দ্রনাথ মহানন্দে সারাদিন ধরে সে-সব সমাধান করতেন।

অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা তাঁর এতটাই ছিল যে, অল্পবয়সেই এই বিষয়ে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ফেলেছিলেন। একটি অঙ্ক তিনি প্রচলিত পদ্ধতি ছাড়াও, নিজস্ব উদ্ভাবিত একাধিক পদ্ধতিতে কষতে পারতেন। তাঁর এই প্রতিভার জন্যই হিন্দু স্কুলে পড়ার সময় তিনি পরীক্ষায় একবার একশোর মধ্যে একশো দশ পেয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় গণিতশিক্ষক উপেন্দ্রনাথ বক্সী তাঁর খাতা দেখে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, 'সত্যেন একদিন বিরাট গণিতজ্ঞ হবে!' সেই ভবিষ্যৎবাণী ফলেওছিল অচিরেই।

 

Satyendra1

 

প্রতিভাবান হলেও সত্যেন্দ্রনাথ আর-পাঁচজন গণিত বা বিজ্ঞান সাধকের মতোও ছিলেন না। বারোমাস ল্যাবরেটরির মধ্যে সেঁধিয়ে থাকতে তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন কাব্য-সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক, সঙ্গীতের পাক্কা সমঝদার; ছিলেন যন্ত্রশিল্পী, বহু ভাষাবিদ এবং মারাত্মক রকমের আড্ডাবাজ। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি যন্ত্রের মতো নয়, মানুষের মতো বাঁচতে জানতেন, সেভাবেই বাঁচতে ভালোবাসতেন।

ছোটবেলা থেকেই সত্যেন্দ্রনাথের ভয়ানক চোখের সমস্যা। তাই সেই বয়সেই নাকে উঠেছিল মাইনাস চোদ্দ পাওয়ারের মোটা কাঁচের চশমা। তবে চোখের সমস্যা কিন্তু তাঁর পাঠ-মগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি কোনদিন। বাল্য থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও টেনিসনের কাব্যের অন্ধভক্ত তিনি। তাঁদের অসংখ্য কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ।

শুধু যে সাহিত্যপাঠ করেই সত্যেন্দ্রনাথ ক্ষান্ত ছিলেন, তাই নয়; সাহিত্যরচনার জন্য তিনি নিজেও একদা কলম ধরেছিলেন। তিনি যখন থার্ড ইয়ারে পড়ছিলেন, তখনই বন্ধুদের নিয়ে নিজের সম্পাদনায় 'মনীষা' নামে একটি হাতেলেখা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। পত্রিকাটির মাত্র কয়েকটি সংখ্যা কেবল প্রকাশ পেয়েছিল। তারপর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তবে, সেই কয়েকটি সংখ্যাতেই লেখক হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন আসামের জঙ্গলে তাঁর এডভেঞ্চারের স্মৃতি-কাহিনি। শোনা যায়, লেখাটির সাহিত্যমূল্য ছিল নাকি অসাধারণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজ আর সে লেখাগুলো পাওয়া যায় না, পত্রিকা ও পাণ্ডুলিপি দুই-ই কবে কালের অবহেলায় হারিয়ে গেছে!

হারিয়ে যা যায়নি, তা হল, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত "পরিচয়" পত্রিকার জন্য বাংলায় লেখা সত্যেন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। তাঁর এই প্রবন্ধমালার সংখ্যা গুটিকয়। কিন্তু প্রত্যেকটিই বক্তব্য ও রচনামাধুর্যে স্মরণীয়। আসলে, তাঁর রচনার ভাষা ছিল মুখের ভাষার মতোই প্রাঞ্জল, সঙ্গীতের মতোই স্বচ্ছন্দ।

সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রীতি এসেছিল কিছুটা পারিবারিক বনেদিয়ানার হাত ধরে। তারপর সেটা ভালোবাসার পথ বেয়ে জায়গা করে নিয়েছিল অন্তরে। কৈশোরে পশুপতি ভট্টাচার্য ও গিরিজাপতি ভট্টাচার্য নামে দুই সঙ্গীতপ্রেমী ভাইয়ের সাহচর্যে তাঁর জীবনে যন্ত্রসঙ্গীতশিক্ষার সূচনা হয়েছিল।

 

Satyendra2

 

যন্ত্রসঙ্গীতে তিনি অল্পদিনেই এমন পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন যে, একের পর এক নতুন সুর সৃষ্টি করে দুই ভাইকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গীতে সত্যেন্দ্রনাথের এমন প্রতিভাময় নিষ্ঠা দেখে তাঁরা তাঁকে একটি এসরাজ উপহার দিয়েছিলেন।

তবে শুধু এসরাজ নয়, সত্যেন্দ্রনাথ বাঁশিও বাজাতেন অসাধারণ। প্রাচীন থেকে আধুনিক, শাস্ত্রীয় থেকে ফোক--সমস্ত ধরণের গানেরই তিনি ছিলেন একজন বিমুগ্ধ ও সমঝদার শ্রোতা।

সঙ্গীত ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার প্রতি তাঁর অত্যন্ত মুগ্ধতাময় অনুরাগ ছিল। আসলে সেই অনুরাগ এবং বিদেশি ভাষার সদ্য প্রকাশিত বইগুলো (সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক) পাঠ করার স্পৃহা থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ জার্মান ও ফরাসি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। সেই সময় ফরাসি সাহিত্যবিদ হিসেবে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর খুব নামডাক। তাঁর বাড়ির বিরাট লাইব্রেরীটিরও সমান সুখ্যাতি ছিল নগরে। বলা বাহুল্য, সেই লাইব্রেরীতে প্রচুর পরিমাণে ফরাসি সাহিত্যের বই ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ নিয়মিত সেখানে গিয়ে সেই সব সাহিত্য পাঠ করতেন।

আসলে, প্রমথ চৌধুরীর "সবুজ পত্র"র আড্ডায় সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন নিয়মিত আড্ডাবাজ। তাছাড়া রবীন্দ্র-কেন্দ্রিক "বিচিত্রা" পত্রিকার আড্ডা, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের "পরিচয়" পত্রিকার আড্ডাতেও তিনি নিয়ম করে হাজির হতেন। এছাড়াও বাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে অলস আড্ডায় দিন কাটিয়ে দিতে তাঁর কোন দ্বিধা কোনদিনই ছিল না। এমনই প্রাণবন্ত ও আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন তিনি।

তবে আড্ডাবাজ এই মানুষটাই যে-সময়টুকু বিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে মগ্ন হতেন, সেই সময়টুকু মগ্নই থাকতেন।কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেই ফিরতেন সেই আগের মেজাজে, অলস আড্ডায়। যাপনের এই স্তর থেকেই কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী।

সত্যেন্দ্রনাথের তখন মাত্র তিরিশ বছর বয়স। তাপ প্রয়োগকালে পদার্থের অণুসমূহের আচরণ সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা ছিল, তা ভেঙে দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নতুন তত্ত্ব। তাতে উন্মোচিত হয়েছিল পদার্থ বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত। তাঁর সেই যুগান্তকারী গবেষণাকে প্রথম সম্মান জানিয়ে এবং গবেষণাপত্রটি স্বয়ং আইনস্টাইন অনুবাদ করে ছাপিয়েছিলেন জার্মান ভাষার পত্রিকায়। সত্যেন্দ্রনাথের তত্ত্বটি বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত হয়েছিল, 'বোস-সংখ্যায়ন' বা 'বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন' নামে।

আসলে, গাণিতিক যুক্তিপ্রয়োগে আবিষ্কৃত ও প্রতিষ্ঠিত পদার্থ বিজ্ঞানের নতুন এই তত্ত্বটির ফলে সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানী-মহলে জয়-জয়কার পড়ে গিয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথের নামে। আর এভাবেই সার্থক হয়েছিল হিন্দু স্কুলের গণিত-স্যারের ভবিষ্যৎবাণী, সত্যেন একদিন বিরাট গণিতজ্ঞ হবে!...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...