ভারতবর্ষের কিশোরদের জীবন নিয়ে প্রথম কিশোর-উপযোগী চলচ্চিত্রের জনক সত্যেন বসু

বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের অন্যতম দিকপাল চিত্রপরিচালক সত্যেন বসু। ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির আগে সত্যজিৎ রায় যে-সমস্ত বাংলা ছায়াছবি ও বাঙালি চলচ্চিত্রকারের কাজ দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন, তার মধ্যে সত্যেন বসু ও তাঁর ‘বরযাত্রী’ ছবিটি অন্যতম। ‘বরযাত্রী’ ছবিটিতে অভিনেতাদের স্বাভাবিক অথচ অপূর্ব অভিনয়, পরিচালকের সিচুয়েশন তৈরির অসাধারণ নৈপুণ্য এবং চরিত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত সরস সংলাপ সত্যজিতের খুবই ভালো লেগেছিল। আপামর দর্শকেরও। তাই ১৯৫১ সালে নির্মিত কমেডি ছবি ‘বরযাত্রী’ ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়ে এখনও সমান জনপ্রিয়, সমান আমোদদায়ী।

সেই অতিনাটকীয়তা ও নাট্যধর্মী চিত্রনির্মাণের যুগে ছায়াছবি নির্মাণের সময় বহমান ধারাটিকে উপেক্ষা করে সিনেমার স্বতন্ত্র ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া, প্রতিভা না-থাকলে সত্যেনের পক্ষে সম্ভব হত না। তাছাড়া সত্যেন নিজেও থিয়েটারে অভিনয় করতেন, কলকাতায় শখের থিয়েটার-গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। থিয়েটারের অনেক বড় বড় অভিনেতা সিনেমায় অভিনয় করতে এসেও থিয়েটারের উঁচু তারে বাঁধা অভিনয় ভুলতে পারেন না, সেখানে সত্যেনের পক্ষে ঐ থিয়েটারধর্মীতাকে অতিক্রম করে বাংলা ও হিন্দি সিনেমার কৃতী পরিচালক হয়ে ওঠা কম কথা ছিল না। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ভাষাটা তিনি মাতৃভাষার মতোই জানতেন। কেননা, ১৯১৬ সালের ২২ জানুয়ারি তিনি তৎকালীন বিহারের পূর্ণিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই বড় হন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় আসেন। বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক হন।

 

SatyenBose1

 

কলকাতায় শখের থিয়েটারগোষ্ঠীতে অভিনয় করতে করতে এবং সিনেমা দেখতে দেখতেই একদা সত্যেনের ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল সিনেমা-মাধ্যমটির প্রতি। সেখান থেকেই সিনেমা তৈরির বাসনা তাঁর অন্তরে জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু পড়াশুনোর পর ব্যাঙ্কের চাকরি করতে করতে সেটা করা সেই সময় তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা, তখন সিনেমা তৈরি করতে হলে বা সিনেমা তৈরির কাজ শিখতে হলে কোন স্টুডিওতে চাকরি নিতে হত। ব্যাঙ্কের কাজ ছেড়ে সেটা তাঁর পক্ষে সেই মুহূর্তে করা সম্ভব ছিল না।

তবে চারের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন কলকাতায় স্টুডিও-সিস্টেম ভেঙে বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউসের অধীনে ছবি তৈরি শুরু হল, তখন তার সুযোগ নিলেন সত্যেন। ১৯৪৮ সালে চাকরির জমানো টাকা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একটি প্রোডাকশন হাউস তৈরি করে ফেললেন। নাম দিলেন, ‘ন্যাশন্যাল প্রোগ্রেসিভ পিকচার্স’

‘ন্যাশন্যাল প্রোগ্রেসিভ পিকচার্স’-এর ব্যানারে প্রথম ছবি করলেন হেমেন গুপ্ত। ছবির নাম, ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮)। প্রথম ছবিটিই অসাধারণ সাফল্য লাভ করল। বাংলা ভাষায় সর্বকালের সেরা ছবিগুলোর তালিকায় স্থান করে নিল এই ছবি। ছবির অন্যতম প্রযোজক হিসেবে শ্যুটিং চলাকালীন সত্যেন যা অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন, তাকে সম্বল করেই পরের বছর নেমে পড়লেন চিত্রপরিচালনায়। শুধু তাই নয়, ছবি তৈরির প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই, কোনরকম শিক্ষানবিশি ছাড়াই বাংলা চলচ্চিত্রের এক নতুন ধারা সূচনার মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনা করলেন। তাই ১৩৫৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় ‘চিত্রবানী’ পত্রিকায় লেখা হল-

“ন্যাশন্যাল প্রোগ্রেসিভ পিকচার্স, যাঁরা ‘ভুলি নাই’ তুলেছিলেন, ছোটদের উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলার কাজে হাত দিয়েছেন। ভারতে এই রকম পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলার ব্যাপারে তাঁরাই হবেন পথ প্রদর্শক। ছবিটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পরিবর্তন’ এবং পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছেন সত্যেন বসু।”

 

SatyenBose2

 

‘পরিবর্তন’ (১৯৪৯) ছবিটির কাহিনিতে রয়েছে বোর্ডিং স্কুলে কিশোরদের বেড়ে ওঠা ও তাদের তেতোমিঠে অভিজ্ঞতার কথা। বলা বাহুল্য, ছবিটি ‘প্রথম জাতীয় কিশোর চলচ্চিত্র’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। ছবিতে পরিচালনার পাশাপাশি সত্যেন অভিনয়ও করেছিলেন। সুরকার হিসেবে কাজ করেছিলেন সলিল চৌধুরী, গান লিখেছিলেন কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ আর সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন পরবতীকালের বিখ্যাত চিত্রপরিচালক তপন সিনহা। সমগ্র বঙ্গদেশে ছবিটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র-ব্যবসায়ীদের তা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে, পরের ছবি ‘বরযাত্রী’ (১৯৫১)-র অভাবনীয় সাফল্যের পরই সুযোগ বুঝে তাঁরা সত্যেনকে বম্বে ডেকে নেন।

সত্যেন বম্বেতে গিয়ে তাঁদের অনুরোধে প্রথমেই ‘পরিবর্তন’ ছবির কাহিনি অবলম্বনে হিন্দিতে ‘জাগৃতি’ (১৯৫৪) ছবিটি পরিচালনা করলেন। ছবিটি দর্শকের ভালোবাসায় ভারত জয় তো করলই, সেই সঙ্গে সেরা ছবি হিসেবে ১৯৫৬ সালের ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারও অর্জন করে নিল। ছবিতে অভিনয় করে অভি ভট্টাচার্য পেলেন সেরা সহ-অভিনেতার পুরস্কার। ছবির ‘আও বাচ্চো তুমহে দিখায়েঁ’ গানটি দেশাত্মবোধক গান হিসেবে সকলের প্রিয় হয়ে উঠল। পাশাপাশি এই এক ছবিতেই ভারতীয় ছায়াছবির জগতে সত্যেনের স্থানটি পুরোপুরি পাকা হয়ে গেল।

সত্যেনের ছবির একটি বড় গুণ হল, বিষয় বৈচিত্র্য। বাংলায় কিশোরদের ওপর ‘পরিবর্তন’ ছবি করে সাফল্য পেয়ে তিনি কিন্তু তার পুনরাবৃত্তি করেননি। পরিবর্তে রোমান্টিক কমেডি ‘বরযাত্রী’ পরিচালনা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। হিন্দিতে ‘জাগৃতি’র সাফল্যের পর তিনি ‘বন্দিশ’, ‘রিকশাওয়ালা’ (১৯৫৫)-র মতো সিরিয়াস ছবিতে হাত দেন ও সাফল্য লাভ করেন।

সিরিয়াস ছবির সরণি বেয়েই সত্যেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বাংলা ছবি ‘বন্দী’ (১৯৪২) অবলম্বনে হিন্দিতে ‘বন্দী’ নির্মাণ করলেন ১৯৫৭ সালে। এই প্রথম ছায়াছবিতে অশোক কুমার, অনুপ কুমার ও কিশোর কুমার—তিন গাঙ্গুলিভাইকে একসঙ্গে অভিনয় করিয়ে নিলেন সত্যেন। তার ওপর মূলত কমেডি ধারার অভিনেতা কিশোর কুমারকে দিয়ে এই ছবিতে একটি সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করানো, সেও বেশ কৃতিত্বের কাজ। ‘বন্দী’তে একাধারে দায়িত্ববান ভাই ও ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া মাধবের চরিত্রে কিশোরকে দিয়ে অসাধারণ অভিনয় করিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়সত্তার সম্পূর্ণ অন্য একটি দিক চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন সত্যেন।

 

SatyenBose3

 

সিরিয়াস চরিত্রের পর পরের বছরই সত্যেন অবশ্য আবার কিশোরকে স্ব-ইমেজে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ নামের অত্যন্ত জনপ্রিয় রোমান্টিক-কমেডি ছবিতে। এবং, এই ছবিতেও সত্যেন তিন ভাইকে একসঙ্গে চমৎকার অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন।

কমেডির পর সত্যেন আবার ফিরলেন সিরিয়াস ছবিতে। ১৯৬৪ সালে বিশেষভাবে সক্ষম দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে তৈরি করলেন ‘দোস্তি’ ছবিটি। ছবিটি সাফল্যে রেকর্ড তো করলই, সেই সঙ্গে মস্কো ইন্টারন্যাশন্যাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জায়গা করে নিল। দেশে ছ’টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করল। শুধু তাই নয়, দেশ-বিদেশে প্রশংসিত এই ছবিটি মালয়ালম ও তেলুগু ভাষায় পুনর্নির্মিত হল।

হিন্দি চলচ্চিত্রে ছয়ের দশক থেকে যে তৃতীয় ধারার চিত্র নির্মাণের পথ তৈরি হয়েছিল। তাতে সত্যেনের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাঁর ছবিতে আর্ট ও কমার্শিয়াল ধারার অনবদ্য মেলবন্ধন ঘটেছে। তাঁর ‘রাত আউর দিন’ (১৯৬৭), ‘মাসুম’ (১৯৬০), ‘আসরা’ (১৯৬৬), “অয়াপস” (১৯৬৯), ‘আনোখী পহেচান’ (১৯৭২), ‘সাঁচ কো আঁচ নেহি’ (১৯৭৯), ‘কায়া পলট’ (১৯৮৩) এবং তাঁর শেষতম ছবি ‘ওহ দিন আয়েগা’ (১৯৮৭)-তেও সেই সৃষ্টিপথের বৈচিত্র্যময় মেলবন্ধন দর্শক আজও উপভোগ করেন।

বলিউডে একদা বাঙালির গৌরবের জয়ধ্বজা উড়িয়েছিলেন যে বাঙালি চিত্রপরিচালক,  ভারতীয় সিনেমায় যাঁর অবদান আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, সেই সত্যেন বসু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৯৩ সালের ৯ জুন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...