আপোষহীন এক সাহিত্যিকের গল্প

ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী, পূর্ণিয়ার ভাট্টাবাজারের ডাকসাইটে উকিল। তাঁর যেমন গরম মেজাজ, তেমনি রাশভারী চেহারা, আর তেমন জলদগম্ভীর গলা। তাঁরই ছেলে সতীনাথ ভাদুড়ী। জন্ম, ১৯০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। তিন ভাই ও চার বোনের কোলে সতীনাথ কনিষ্ঠ। কিন্তু, বাপের মতো তিনি না-পেলেন চেহারা, না-পেলেন মেজাজ। তবু বাপ চেয়েছিলেন ছেলে তাঁরই মতো ওকালতিতে নাম করুক। তাই ১৯৩১ সালে বিএল পাশ করে ১৯৩২ থেকে প্র্যাকটিস শুরু করলেন সতীনাথ। চলল মাত্র ১৯৩৯ সাল অব্দি। কারণ, এই পেশাটাকে তিনি কোনদিনই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, সাত বছরের পেশাজীবনেও পারলেন না।

ছাত্রজীবনে ভগ্নস্বাস্থ্যের কিশোর সতীনাথ বরাবর ফার্স্ট হতেন এবং একেবারেই ডানপিটে ছিলেন না। তবু একবার, হ্যাঁ জীবনে একবারই, বিজয়া দশমীর আনন্দে নিতান্তই 'কেমন লাগে' দেখতে গিয়ে সিদ্ধি চেখে দারুণ বিপত্তি ঘটিয়ে ফেললেন। প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেল। পাড়ার ডানপিটের দল কাঁঠাল পাতা চিবিয়ে নেশা কাটিয়ে ফেলল, কিন্তু, তাঁর নেশা কাটল না। ডাক্তার ডাকতে হল। তারপর রাশভারী বাবার হাতে তাঁর যে অবস্থা হল সে আর না-বললেও বেশ বোঝা যায়! পরিশেষে যা হবার তাই হল, কিছুদিন বাড়ি থেকে বেরুনই বন্ধ হয়ে গেল।

ছোটবেলা থেকে সতীনাথ মায়ের কাছ থেকে অনেক সদগুণ অর্জন করেছিলেন। ছিলেন মৃদুভাষী, বইপোকা, কর্মনিষ্ঠ, আদর্শবান এবং গান্ধীজির ভক্ত।  তিনি যা করতেন মন দিয়েই করতেন, এবং তাতে মেধার পরিচয় রাখতেন। মাত্র সাত বছরেই আইনজীবী-জীবন শেষ করে ফেললেও, তিনি যেভাবে কেস সাজাতেন, তাতে বার কাউন্সিলের সিনিয়ার উকিলরাও বলতে বাধ্য হতেন, 'এতো আর একটা ইন্দুবাবু তৈরি হয়ে গেছে!'

এমন সার্টিফিকেট পাওয়ার পরও সতীনাথ প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলেন। কারণ, তাঁর ভাষায়, 'পাটোয়ারী মাথাটার সঙ্গে অধ্যবসায়ী লাজুক মনের বিরোধিতা বেশিদিন চলল না।'

১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু। দেশ তখন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল উদগ্রীব। এই অবস্থায় সক্রিয় রাজনীতি থেকে সতীনাথ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। ওকালতিকে দুত্তোর বলে ২৪ সেপ্টেম্বর টিকাপট্টি আশ্রমে গিয়ে কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী হিসেবে যোগদান করলেন। এটা কোন হঠাৎ একটি খেয়ালবশের ঘটনা নয়, প্রেক্ষাপটে আছে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। গান্ধীজির প্রতি ভক্তি তো ছিলই। তার ওপর ১৯৩১ সালে 'নবশক্তি' পত্রিকায় 'লন্ডনে গান্ধীজী'-নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তাঁর স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। ওকালতি করতে করতেও বলীপ্রথা তুলে দেওয়ার জন্য আন্দোলন, মদের দোকানের সামনে পিকেটিং সংগঠিত করেছেন। যাইহোক, তাঁর এই সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনও কিন্তু মাত্র ন'বছরের। এই পুরো সময়টাই তিনি পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের সেক্রেটারি। সংগঠনের হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে তখন তিনি পুলিশের চোখ এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে পনের-বিশ মাইল হেঁটে সভা-সমিতি করছেন, ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ করছেন, কাটিহার জুটমিলের ধর্মঘটি মজুরদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের সঙ্গে দিনের পর দিন থেকে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, জেল খাটছেন। এই ন'বছরে তিনি তিন বার জেল খেটেছেন। আর এসব করতে গিয়ে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের সঙ্গে যেমন তাঁর আত্মীয়তা হল, তেমনি নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মীদেরও দেখলেন। আর দেখলেন স্বার্থান্বেষী উঁচুতলার নেতাদের। পরবর্তীকালে এঁরা সবাই তাঁর সাহিত্যে সত্য ও সময়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠে এসেছিল।

সতীনাথ রাজনীতিতে এসেছিলেন দেশের জন্য। আপোষ করে রাজনীতিক হতে নয়। সেটা তাঁর স্বভাবও নয়। বাবা প্রতিষ্ঠিত উকিল, গাড়িতে করে কোর্টে যেতেন। সতীনাথ ওকালতিজীবনে কোনদিন বাবার গাড়িতে করে কোর্টে যাননি। বাবার অনুরোধেও যাননি। নিজের সাইকেলটির ওপরেই ভরসা রেখেছেন। সেই লড়াইয়ের দিনগুলোতেও 'প্রতিষ্ঠা'-র সঙ্গে যে লোকটি আপোষ করেননি, বাবার সঙ্গে আপোষ করেননি; সেই তিনি অন্য কারও সঙ্গে আপোষ করবেন কী করে! তিনি যখন দেখলেন গান্ধীজির আদর্শকে ঢাল করে স্বার্থান্বেষীতে দল ভারি হচ্ছে, যখন দেখলেন স্বাধীনতার পর দরিদ্র সাধারণের স্বার্থ উপেক্ষা করে ১৯৪৮ সালে পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেসের বিশাল ভবন তৈরি হচ্ছে, তখন তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। পদত্যাগ করলেন। পার্টির থেকে সমস্ত সংশ্রব ত্যাগ করলেন।

সাহিত্যিকের কলম সতীনাথ ধরেছিলেন রাজনীতিকজীবনেই। প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে এসে, গত শতকের চারের দশকের শুরুতে। তাঁর দেখা মানুষ, দেখা জীবন; জেল জীবনের অভিজ্ঞতা, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মানুষ, স্বাধীনতার জন্য ব্যবহৃত মানুষদের তুলে আনলেন তাঁর সৃষ্ট প্রথম সাহিত্যে। দেশের জন্য উৎসর্গ করা একটি পরিবারের মনোবিশ্লেষণ করলেন 'জাগরী' উপন্যাসে। উপন্যাসের পরিবারটির মনন আসলে গত শতকের চারের দশকের প্রথমার্ধে সমগ্র দেশের মননের প্রতিনিধি। তারপর, 'রাম চরিত মানস'-এর কাঠামোয় প্রান্তিক মানুষকে মহাকাব্যিক নায়ক করলেন, রচনা করলেন 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'। তারপর একে একে লিখলেন, 'অচিন রাগিনী', 'সংকট', 'দিগ ভ্রান্ত', 'সত্যি ভ্রমণ কাহিনী'-র মতো বিচিত্রধর্মী উপন্যাস। লিখলেন, 'গণনায়ক', 'চিত্রগুপ্তের ফাইল', 'অপরিচিতা'-র মতো বলিষ্ঠসব ছোটগল্পের সংকলন গ্রন্থ।

সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ী আমাদের কাছে এই জন্য প্রণম্য যে, তিনি দেশকে 'মা মা' বলে নমস্য করে নিছক ঘন্টা নেড়ে পুজো করতে বসেননি। তাকে পরাধীনতা থেকে উদ্ধারের পথে বিলাসী স্বপ্ন দেখানোর ফেরিওয়ালা হয়ে যাননি। নিজের মতো করে পরিস্থিতির মোকাবিলায় নেমেছিলেন, জেল খেটেছিলেন, নিজস্ব উচ্চারণে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং বিশ্বাসকে সাহিত্যে প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যে মন-সমীক্ষার প্রচলিত ধারায় নবতর পথের সন্ধান দিয়েছেন, অস্পৃশ্য-অন্ত্যজ-প্রান্তিক জীবনকে রামগাথার মতো মহীয়ান করেছেন।



তথ্যঋণ : 'সতীনাথ ভাদুড়ী জীবন ও সাহিত্য' - শ্রীঅরূপকুমার ভট্টাচার্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...