নির্জন হাভেলি। নিষ্প্রাণ অন্দরে খাঁ খাঁ শূন্যতা। কেবল তিনি একা। গুমরে গুমরে দিন গুণে চলেন। মনের মধ্যে গনগনে আঁচে জ্বলতে থাকা প্রতিশোধের লাভাটাকে তিনি কোনওভাবেই ঠান্ডা হতে দিতে চাননা। কাঁধ থেকে যেমন এক মুহূর্তের জন্য সরতে দিতে চান না চাদরটাকে। গাঁয়ের লোকে তাঁকে মান্য করে চলে। কিন্তু তাঁর সব কিছু থমকে যায় চোখের সামনে নিশ্চল পাথর প্রতিমার মতো পুত্রবধূকে দেখলে। সাদা ঘোমটায় ঢাকা তরুণীর সামনে যেন বারবার খসে পড়ে চাদর। কাঁধের নিচ জানান দেয় ‘ঠাকুর সাব’ আসলে এক ব্যর্থ মানুষ।
সারা দেশ তাঁকে চেনে 'ঠাকুর সাব' নামে। এক দুধর্ষ ডাকাত গ্রামের অতন্দ্র প্রহরী।
আসল নাম হরিহর জেথালাল জরিওয়ালা। মুম্বইয়ের ফিল্মি দুনিয়ায় তিনি জনপ্রিয় ‘ হরিভাই’ নামে।
আর দর্শকদের কাছে ‘সঞ্জীব কুমার’।
জন্ম ১৯৩৮ সালের ৯ই জুলাই এক গুজরাতি পরিবারে। পরিবারের সঙ্গে শৈশব কাটে সুরাটে। পড়াশোনা গুজরাটি মিডিয়াম স্কুলেই। পরে পাকাপাকি ভাবে পরিবারের সঙ্গে মুম্বই।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জীবন খুব সহজ ছিল না। হয়ত সেই কারণেই ‘ কমন ম্যান’ ফ্যাক্টর চিনিছিলেন খুব সামনে থেকে।
একেবারে শুরুর দিকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটারে চুটিয়ে গুজরাটি থিয়েটার করতেন। প্রবীণ যোশীর পরিচালনায় তাঁর অভিনয় নজর টানত দর্শকদের। কিন্তু হরিভাই এর লক্ষ্য ছিল বলিউড। পর্দায় দুনিয়ার গ্রামার রপ্ত করতে ভর্তি হলেন ফিল্মিওয়ালা একটিং স্কুলে।
আইপিটি-এর সদস্য হয়েছিলেন। মঞ্চেও তিনি নিজের প্রকৃত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক চরিত্রে অভিনয় করতে পছন্দ করতেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি আর্থার মিলারের মঞ্চনাটক ‘অল মাই সনস’ এ একজন বয়স্ক মানুষের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন।
বৃদ্ধ, প্রৌঢ়ের চরিত্রে অভিনয় করার ঝোঁকটা তাঁর নিজস্ব সিগনেচার স্টাইল হয়ে দাঁড়ায় এক সময়।
চলচ্চিত্রে সঞ্জীব কুমারের অভিষেক ঘটে ১৯৬০ সালে ‘হাম হিন্দুস্তানি’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৫ সালে ‘নিশান’ ছবিতে তিনি প্রথমবার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।
ত্রিশূল ছবিতে শশী কাপুরের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। শশী তাঁর চেয়ে বয়সে বেশ সিনিয়র।
নিজের অভিনয় আর চরিত্র নিয়ে আজীবন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন। ৭০-৮০ দশকে হিন্দি ছবিতে নায়কের বদলে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের অফারগুলো আসছিল সেভাবেই। ওজন বৃদ্ধির কারণে নায়কের চরিত্রে তাঁকে আর ভাবা হচ্ছিল না। তাঁর যেন তত বেশি চ্যালেঞ্জিং রোলের খিদে বাড়ছিল। নজর দিচ্ছিলেন দক্ষিণী ছবিতেও। বহু সফল দক্ষিণী ছবির প্রধান ভূমিকায় তিনি। তাঁর ডেট পাওয়ার জন্য প্রয়োজকদের হন্যে হতে হত। গুজরাটি এবং পঞ্জাবি ছবিতেও কাজ করেছেন। সঙ্গে থিয়েটার। এমন কোনও অভিনয় মাধ্যম ছিল না যেখানে তিনি কাজ করেননি। হিন্দি উর্দু দুই ভাষাতেই ডায়ালগ ‘ডেলিভারি’ করতে পারতেন সমান দক্ষতায়। কয়েক মিনিট সিন শেষ। তাই সেটে 'লেটে' আসা মেনে-মানিয়ে নিতেন পরিচালকরা।
সাদা পাজামা কুর্তি, সাদা জুতো, সাদা মার্সিডিজ আর ৫৫৫। এই ছিল তাঁর নিজস্ব স্টাইল। এমনিতে নিপাট ভদ্রলোক হিসাবে ইন্ডাস্ট্রিতে সুনাম থাকলেও সাংবাদিকদের ‘পরীক্ষা’ নিতে ছাড়তেন না। আর সেই পরীক্ষায় পাশ করলে হরিভাই দিলদরিয়া মানুষ।
দিনের বেলায় ‘সঞ্জীব কুমার’। রাতের বেলায় ‘হরিভাই’। দ্বৈত চরিত্রের জীবনে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলেন নিজেকে। নাহলে রুপালি দুনিয়ার চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে সময় লাগে না। সূর্য ডুবলে সেটের কাজ শেষ হলে পৌঁছে যেতেন লিংকিং রোডের ‘চপসি’তে। সেখান থেকে ‘জয় জওয়ান জয় কিসান’ ধাবায়। স্কচ আর টেংরি কাবাব। অথচ বাড়ি জানত তিনি ‘ভেজিটেরিয়ান’। তিনি নিজেও স্বীকার করতেন যে তিনি ভেজিটেরিয়ান। কিন্তু সেটা শুধু বাড়িতে। স্কচ-এর প্রতি হরিভাই এর দুর্বলতা প্রবাদ হয়ে গিয়েছিল
বোম্বাই শহরের মোহিনী রাত। নেশায় ভর করে মাটিতে নেমে আসত যত অশরীরী বিপন্নতা। বুকের সিন্দুকে জমে থাকা ব্যাথা তখন মেহফিল সাজিয়ে বসেছে। তাদের মুখোমুখি হরিভাই। যেন অন্য মানুষ। অন্তহীন বিরহের ঘোরে একলা অধীশ্বর। ইন্ডাস্ট্রির স্বপ্নসুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু সেই সুন্দরী নোঙর ফেলেনি তাঁর হৃদয়ে।
বারবার পুড়েছেন। তবে বিরহের আবেশ থেকে বেরতে চাননি কোনওদিন। কোনও মানুষ নয় প্রেম নামক এক ঘোরের সঙ্গে বসত হয়ে গিয়েছিল বোধহয়।
হৃদয়ের ক্ষত তাঁর আজীবনের সঙ্গী। নিজেও জানতেন। তাই এক খন্ড জীবনের পাতায় মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন সমস্ত সাধ। ডাক্তারদের সাবধানবাণী হেলায় উড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হামকো কাঁহা হাজার সাল জিনা হ্যায়, থোড়ি সি জিন্দেগী হ্যায়...’
তথ্য ঋণ: আলি পিটার জন, ফিল্মফেয়ার