মহালয়া থেকে কোজাগরী আরাধনা বাঙালি ‘সন্ধ্যাময়’

অষ্টমীর অঞ্জলি তখন শেষ হয়ে গিয়েছে। মন্ত্রপাঠ শেষ। পাড়ার প্যান্ডেলের চোঙ্গা যন্তরটার দিকে তেমন একটা কান নেই কারও। সহসা এলেন তিনি। ঝিমিয়ে থাকা দিনের দুপুরে যেমন আচমকা রোদ্দুর ফিরে বদলে দেয় আকাশ ঠিক তেমন করে যেন বদলে দিলেন পুজোর মেহেফিল।

প্যান্ডেলের পাশে বাঁধা মঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোল বালিশ ফেলে আচমকা সবার গান টানটান। কে লাগালো গান খানা?

লাল লা লা লা ..

এই পথ যদি না শেষ হয়

তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?

এ গান কানে এলে আর শুয়ে থাকা যায় না। মধু মালতী ডাক দেয়। গানের মোহে মন ছুটে যায় দূর থেকে দূরে। মাঠ পেরিয়ে ছুটে যায় বাইক। সকালে পুষ্পাঞ্জলির সময় যাকে দেখে খুলে গিয়েছিল বন্ধ চোখের পাতা। ভুল হয়েছিল দূর্গা মন্ত্রে মনে পড়ে তার কথা।

as

এ গান বাঙালির দুর্গাপুজোর রেওয়াজ। এক পুজো যায়, আর এক পুজো আসে থেকে যায় গান আর গানের ঈশ্বরী। তাঁর গানের ইন্দ্রধনু দু চোখে স্বপ্ন ছড়ায়। সেই আবেশে বার বার মুগ্ধ হয় গান পাগল জাতি। বাংলা গানের সরস্বতীর কাছে প্রাণ মন সব কিছু সঁপে দেয় তারা।

দুর্গাপুজোর গান কানে হেমন্ত-মান্নার সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় যে নাম তিনি সন্ধ্যা। তিনি চিরকালের। তাই আজও ডিজিটাল দুনিয়ায় ‘পুজোর গান’ সার্চ দিলেই আসে ‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গান’।

মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী আলখ্যে তাঁর কণ্ঠে‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’ ঘুম ভাঙ্গে। কদিন পর দেবীর বোধন পুজো প্যান্ডেল সন্ধ্যাময়। এ গান কখনও পুরনো হয় না। সারাদিন স্বর্ণযুগ।

পুজোর গানে তাঁর রেকর্ডের জন্য চলত লাগাতার অপেক্ষা। রেকর্ডের যুগ পেরিয়ে ক্যাসেট আর ডিস্কের যুগেও সন্ধ্যা এভারগ্রিন। তাঁর জীবনের শেষ অ্যালবামও বেরিয়েছিল এমন এক পুজোতেই।

২০০৩ সালে ষষ্ঠীর দিন এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শেষ অ্যালবাম ‘অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে’। পরিচালনায় কবীর সুমন।

গান রেকর্ডিং-এর আগে মৌন থাকতেন তিনি। দরকারী কথা বলতেন চিরকুটে। এ ছিল তাঁর বহু পুরনো অভ্যাস। বয়সে ছোট শিল্পীদেরও সেই পরামর্শ দিতেন। অহেতুক কথা বললে গলায় বাড়তি ধকল আর মনোস়ংযোগ নষ্ট হবে। বলতেন, ‘‘আস্তে কথা বল। বেশি কথা বোলোই না। এতে গলা খারাপ হয়ে যাবে।’’

রেওয়াজের উপর খুব জোর দিতেন।তাঁর শয়ণ–স্বপন-দিনমান জুড়ে থাকত গান। তিনি বলতেন, সঙ্গীত হল ঈশ্বর। তাঁর করুণা না থাকলে গানবাজনা হয় না।

যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখা শুরু করা সন্ধ্যা পরে নাড়া বেঁধেছিলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের কাছে। পরে তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছেও পাতিয়ালা ঘরানার রসসমুদ্রে অবগাহন চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই ভিত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে গোটা গান জীবন ধরে সঙ্গ দিয়েছে।

বোম্বাই গিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মণের ডাকে। তাঁর সুরেই ‘সাজা’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ‘গুপচুপ গুপচুপ পেয়ার করে’ খুব জনপ্রিয় হয়। হিন্দিতে প্রথম প্লে-ব্যাক তারানা-য়। অনিল বিশ্বাসের সুরে লতার সঙ্গে তাঁর গান ‘বোল পাপিহে বোল’-এ মেতেছিল গোটা দেশ। অনিল বিশ্বাসেরই সুরে ফরেব ছবিতে ‘উদাসিয়োঁ‌ মে নজ়র খো গয়ি’র মতো গান শুনিয়েছিলেন শ্রোতাদের। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের মুম্বইবাসে ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেন সন্ধ্যা।

বাংলা গানে সন্ধ্যা এক ইতিহাস। যা বুক দিয়ে আগলে রাখতে চাই প্রতিটি বাঙালি। কিন্তু তাঁর নিজের শহরেই ভেঙ্গে পড়ে তাঁর বাড়ি। যে বাড়িতে আমৃত্যু বসত করেছিলেন তিনি। শ্রোতাদের হৃদয় রক্তাক্ত হয় কিন্তু কিছু করার থাকে না। আসলে শ্রোতাদের ‘সন্ধ্যা’ মৃত্যুহীন এক অক্ষয় প্রাণ। গান আর কণ্ঠ দিয়েই গড়ে গিয়েছেন নিজের দুনিয়া। কোনও আঘাতেই গুঁড়িয়ে যায় না গীতশ্রীর গানের পৃথিবী।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...