সমরেশের লিখনগাথা

১৯৪৬ সাল। ১৬ অগাস্ট মুসলিম লীগ স্বতন্ত্র দেশ পাকিস্তানের দাবিতে হরতাল ও সমাবেশের ডাক দিল। সেই দাবিকে নস্যাৎ করতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সমর্থকরা পাকিস্তান বিরোধীতার শ্লোগান তুলল। পারস্পরিক বিরুদ্ধতার এই প্রকাশ্য সুযোগে হিন্দু-মুসলমানের দীর্ঘ অবিশ্বাস ও ঘৃণা পাকিয়ে উঠল। এবং, শাসকের ইন্ধনে অবিলম্বে তা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিয়ে নিল। শুরু হল খুনোখুনির দিন। কলকাতা থেকে এই দাঙ্গা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল বৃহৎবঙ্গে। বয়ে চলল রক্ত ক্ষয়ের প্রহর।

সমরেশ বসু এই কালপর্বে যুবক। ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির এক সাধারণ কর্মী। থাকেন জগদ্দল-আতপুরে। বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত। টুকটাক লেখালেখি করেন। শখে নয়, দায়ে। মানবিকতার দায়ে এবং একটি পত্রিকার লেখক হওয়ার দায়ে। পত্রিকাটি হাতে লেখা। তাঁদের বামপন্থী সংগঠন উদয়ন সংঘের পত্রিকা। 'উদয়ন'। পত্রিকাটির সম্পাদক বন্ধু গৌর ঘোষ। সমরেশ এই পত্রিকার শুধু লেখকই নন, নিবেদিতপ্রাণ প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী এবং কপিরাইটার।

সমরেশের লেখা যদিও কোন নামি বা অনামি পত্রিকার পাতায় বের হয়নি, তবু লেখা জমছে একটি একটি করে। গঙ্গার ধারে বসে সেই সব লেখা একে একে শুনছেন সমরেশের প্রথম শ্রোতা গৌর। শুনে বিহ্বল হচ্ছেন, উদ্বেল হচ্ছেন। উদগ্রীব হচ্ছেন প্রতিটি লেখা নামজাদা পত্রিকার পাতায় ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য। বায়না জুড়ছেন পত্রিকার দপ্তরে দিয়ে আসার জন্য। গৌরের সেই অসম্ভব আগ্রহকে অনেক কষ্টে প্রশমিত করছেন সমরেশ। তিনি ছাপতে দিতে নারাজ। তাঁর মনে অসংখ্য সংশয়। বড় বড় পত্রিকার বড় বড় লেখকের নীচে তাঁর লেখা, তাঁর নাম কি স্থান পাবে? দূর, তাঁর মতো অকিঞ্চিৎকর লেখকের লেখা কে-ই বা পড়বে! না পড়লে, সম্পাদক তাঁকে কেনই বা জায়গা দেবেন! সম্পাদকের হাতে একবার উপেক্ষিত হলে লেখার এই অনাবিল আনন্দধারা যদি নষ্ট হয়ে যায়! তার চেয়ে এই ভালো বাবা। কিছু না থাক, সৃষ্টির আনন্দ তো আছে!

দাঙ্গার আবহ ও আয়োজন কলকাতা থেকে শহরতলী ইছাপুরে পৌঁছতে দেরি হল না। দিন কাটতে লাগল আতঙ্কে। সেই পরিস্থিতিতে পদে পদে জনজীবন ব্যাহত হতে লাগল। কিন্তু, সৃজনশীলতা থেমে রইল না।  প্রস্তুতি চলতে লাগল 'উদয়ন'-এর অগাস্ট সংখ্যা প্রকাশের।

সেদিন ছবি আঁকাআঁকি চলছে, এমন সময় আবির্ভাব হল মাস্টারমশাইয়ের। লোকে বলে, সত্য মাস্টার। তিনি অঞ্চলের বামপন্থী নেতা, সমরেশের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু এবং 'উদয়ন'-এর পরিকল্পক। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, অগাস্ট সংখ্যার বিষয় হবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সবারই মনে হল, হ্যাঁ ঠিকই তো, এই পরিস্থিতিতে তাই তো হওয়া উচিত। ব্যস, অমনি লেখা জোগাড়ের হররা শুরু হয়ে গেল। সমরেশও এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি গল্প লিখে ফেললেন। স্রোতের তোড়ের মতন। পর পর। লিখে তো ফেললেন, এখন গৌরকে না-শোনানো অব্দি তাঁর স্বস্তি নেই। তাকে টেনে নিয়ে গেলেন গঙ্গার ধারে। শুরু করলেন গল্প। ঢাকা শহরের দাঙ্গাকবলিত রাস্তায় দুটি চরিত্র। দুই ধর্মের। হিন্দু ও মুসলমান। একজন বুড়িগঙ্গার মাঝি, অন্যজন নারায়ণগঞ্জের সুতাকলের মজুর। ধর্মীয় ঘৃণা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাঙ্গায় ধর্মভেদের ঊর্ধে দুটি নিতান্ত সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখার অসাধারণ মানবিক গল্প। গল্পের নাম, 'আদাব'। গল্পটি শেষ অব্দি শুনে গৌর অভিভূত হয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে স্থির করে ফেললেন 'পরিচয়' পত্রিকায় পাঠাবেন। হাতে-পায়ে ধরেও এবার আর তাঁকে নিরস্ত্র করতে পারলেন না সমরেশ।

'পরিচয়'  বাংলা  ভাষার  স্বনামধন্য  পত্রিকাগুলোর একটি।  নামজাদা  লেখকদের পীঠস্থান।  সেখানে  লেখা পাঠানো  তো  হল। তারপর মনে একটা অস্বস্তি যেন চেপে বসে রইল।  এই বুঝি লেখা অমনোনীত হয়ে ফেরৎ এল! সবসময় একটা কী হয় কী হয় দুশ্চিন্তা!  এমনধারা উত্তেজনায় মাসখানেক কেটে গেল। না, তার মধ্যে লেখা ছাপা হবার কোন খবর এল না, লেখাও ফেরৎ এল না। সময়ের স্রোত বইতে লাগল।  উত্তেজনাও কমে এল একদিন। আর ঠিক তখনই এক সকালে গৌর ছুটতে ছুটতে এলেন সমরেশের বাড়ি। হাতে শারদীয়া 'পরিচয়'-এর একখানা বিজ্ঞাপন। সেটি মেলে ধরলেন সমরেশের সামনে। তাতে লেখা, 'গল্প লিখছেন : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও সমরেশ বসু।' শেষে যে তাঁরই মতো একটি নাম! সন্দেহ হলে, নমস্য সব লেখকদের সঙ্গে যে 'সমরেশ বসু'র নাম ছাপা হয়েছে, সেই সমরেশ বসুই কি তিনি? যদি তা-ই হয়, সে যে অবিশ্বাস্য! সমরেশের মনে যখন এসব ওঠাপড়া চলছে, তখন গৌরের মুখে তৃপ্তির হাসি। সেই হাসিই বুঝিয়ে দিচ্ছে অবিশ্বাস্য হলেও এ সত্যি!

'পরিচয়'-এর পাতায় এভাবেই ছেচল্লিশের দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ শারদপ্রাতে 'আদাব'-নামের বিপুল সমাদৃত গল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য পেল এক পরম শক্তিমান লেখক সমরেশ বসুকে। যিনি 'ভ্রমর' ছদ্মনামে রাজনৈতিক উপন্যাসের ধারাকে নতুন পথের সন্ধান দিলেন, 'কালকূট' ছদ্মনামে ভারতের পৌরাণিক আত্মাকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন, স্বনামে লিখলেন 'প্রজাপতি', 'বি টি রোডের ধারে', 'গঙ্গা', 'টানাপোড়েন', 'দেখি নাই ফিরে'-র মতো অজস্র কালজয়ী উপন্যাস। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বিচিত্র বিষয় ও বিচিত্র আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করে গেলেন বাংলা কথাসাহিত্যের ধারাটিকে। আর সেই কালজয়ী সৃজনবৈচিত্র্যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এবং পাঠকের মনে তৈরি করে গেলেন নিজস্ব এক আসন। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...