‘মুড় মুড় কে না দেখ, মুড় মুড় কে’- রাজ কাপুরের ‘শ্রী ৪২০’ ছবির সেই গান মনে পড়ে? ‘নয়না বরসে’, ‘লগ জা গলে’?
কিংবা আশা-রফি ডুয়েটে ‘অভি না যাও ছোড় কর’। গানের কথা মনে গেঁথে যায়। সেই সঙ্গে পর্দার অভিনেত্রীর অভিব্যক্তি।
সহজ অথচ গভীর চোখে তাকিয়ে থাকা। চোখ দিয়ে জয় করে নেন তামাম হৃদয়।
সত্যি সত্যি চোখ দিয়ে দুনিয়া জয় করেছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের যাবতীয় ট্র্যাজেডি আর উত্থান পতনের কারণও ওই চোখই। তিনি যে সাধনা। বলিউড তাঁকে বলত ‘মিস্ট্রি গার্ল’। সাধনা শিবদাসানি।
জন্ম করাচিতে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।
বাবার খুব ভালো লাগত অভিনেত্রী সাধনা বোস। সেই ভালোলাগা থেকেই মেয়ের নাম রেখেছিলেন ‘সাধনা’।
আট বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেছিলেন।
দেশভাগের পর চলে আসেন বোম্বাই শহরে। নতুন বাসা হয় ব্যারাক্সের কাছে সিওন-এ
জয়হিন্দ কলেজে পড়তেন। খুব আগ্রহ অভিনয়ে।
কলেজের নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব আসে। নায়িকার বোনের ভূমিকায়। বয়স তখন ১৫ বছর। পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ১ টাকা।
দেশের প্রথম সিন্ধ্রি ছবিতে অভিনয়ের জন্য তাঁকে নির্বাচন করা হয়। ছবির নাম ‘কাবানা’ (১৯৫৮)।
একটা ফটোগ্রাফ বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। একটি সিনেমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই ছবি নজরে পড়ে যায় শশধর মুখোপাধ্যায়ের। সেই সময়ে হিন্দি ছবির দুনিয়ায় তিনি স্তম্ভ পুরুষ বলা যায়। তাঁর পরামর্শেই আরকে নায়ার ‘লাভ ইন সিমলা’ ছবির জন্য নির্বাচন করেন নবাগতা সাধনাকে। ‘টমবয়’ সাধনা তো হিট করেনই, সঙ্গে তাঁর ‘সাধনাকাট’ ও সমান হিট।
ষাটের দশকে ‘ট্রেন্ডসেটার’ হয়ে উঠেছিলেন। কপালের উপর ফ্রিংগস। আর চুড়িদার কুর্তা। যা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘ওয়াক্ত’ ছবি থেকে।
বিমল রায়ের ‘পরখ’ ছবি থেকে অভিনেত্রী হিসেবে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন সাধনা।
‘সাধনাকাট’ চুল ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছিল মেয়েমহলে। হলিউডের অড্রে হেপবার্ণের অনুকরণে। ১৯৬০-এ রোমান্টিক ছবি ‘লাভ ইন সিমলা’তে প্রথম দেখা গিয়েছিল।
আক্ষরিক অর্থেই মোড় ঘুরে গিয়েছিল জীবনের।
১৯৬৩-তে রিলিজ হল ‘মেরে মেহবুব’। রাজেন্দ্র কুমারের সঙ্গে সেটাই তাঁর প্রথম অভিনয়। ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল। বোরখার আড়াল থেকে শুধু চোখটুকু দেখা যাচ্ছে সাধনার। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সেই দৃশ্য চিরকালীন হয়ে আছে।
ড্যানি ডেনজংপা সেই ফ্রেম দেখে মন্তব্য করেছিলেন ‘আনফরগেটবল’।
রাজ খোসলার থ্রিলার ট্রিলজি ‘উহ কৌন থি’, ‘মেরা শায়া’, ‘অনিতা’, ছবির পর থেকে বলিউডে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘মিস্ট্রি গার্ল’।
বলিউডে তাঁর উজাড় করা সাফল্য কিন্তু কোনও বড় পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়নি তাঁকে। না জাতীয় পুরস্কার।
রাজেন্দ্র কুমার এবং সুনীল দত্তের সঙ্গে পর্দায় তাঁর কেমেস্ট্রি ছিল সবচেয়ে ভালো।
কেরিয়ারের মধ্যগগনে আক্র ন্ত হলেন থাইরয়েডের সমস্যায়। যে চোখের ম্যাজিকে মুগ্ধ ছিল আসমুদ্র হিমাচলের সিনেমা প্রেমিরা সেই চোখই আক্রান্ত হল প্রবলভাবে।
লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যেতে হল চিকিৎসার প্রয়োজনে। সে এক অন্য লড়াইয়ের গল্প। আলোয় ফিরতে চেয়ে অন্ধকারের সঙ্গে প্রতিদিনের লড়াই। লাইমলাইটের অজস্র আলো যাকে ঘিরে রাখত প্রতিদিন, প্রতিটা মুহুর্ত তার পক্ষে এই লড়াই আরো কঠিন।
ছবির ব্যর্থতা বা কেরিয়ারের খরা নয়, এ যেন অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রোগ-দানবের আক্রমণ।
সাধনার ফিল্মজার্নিকে চার পর্বে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্ব ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত। ‘লাভ ইনসিমলা, ‘হাম দোনো’, ‘আ লি-নকলি’ এই তিন ছবিতে অভিনয় আর গ্ল্যামার দিয়ে বোম্বায়ের হিন্দি ছবির দুনিয়ায় নিজের পা শক্ত করেছিলেন সাধনা। ‘পারখ’, ‘মনমাউজি’র মতো ‘নন-গ্ল্যামারাস’ ছবিও এই সময়েই মুক্তি পেয়েছিল।
কেরিয়ারের দ্বিতীয় পর্ব ১৯৬৩ থেকে টানা তিনবছর। ‘এক মুসাফির এক হাসিনা’, ‘মেরে মেহবুব’, ‘উহ কৌন থি’, ‘রাজকুমার’, ‘আরজু’, ‘ওয়াক্ত’, ‘বদতামিজ’-এর মতো হিট ছবির মুক্তিকাল। নায়িকা বা অভিনেত্রী হিসেবে এই সময়টাই সাধনার স্বর্ণযুগ। জনপ্রিয়তা এবং পারিশ্রমিক আকাশ ছুঁয়েছিলেন দু’দিক থেকেই।
১৯৬৬-তে পরিচালক আর কে নায়ারের সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনিই ছিলেন সাধনার বেশির ভাগ ছবির পরিচালক।
তৃতীয় পর্ব ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯। সাধনার এই পর্বের ছবি ‘ইন্তেকাম’, ‘অনিতা’ ‘এক ফুল দো মালি’। এই সময় থেকেই সাধনার চেহারার পরিবর্তন হতে শুরু। বদলে যায় চোখ। থাইরয়েডের সমস্যাও শুরু হয় এই সময় থেকেই।
সাধনার অভিনয় জীবনের চতুর্থ পর্ব বাকি তিন পর্বের থেকে অনেকটাই লএমবি । ১৯৭০ থেকে ৭৮, প্রলম্বিত হয়ে ১৯৯৪। এই সময়টা কেরিয়ারের মূল পর্বের থেকে অনেকটাই আলাদা। বলা যায় তাঁর কামব্যাক পর। বারবার শারিরীক অসুস্থতাকে হারিয়ে ছবির দুনিয়ার মূল স্রোতে ফিরে আসার যুদ্ধ। ‘সচ্চি’, ‘ইশক পর জোর নেহি’, ‘আয়ে দিন বাহার কে’, ‘দিল দৌলত আউর দুনিয়া’, ‘গীতা মেরা নাম’ ‘বন্দনা’ একের পর ছবি করছেন। কিন্তু কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছেন সেই গ্ল্যামার কুইন। আলোর বিচ্ছুরণ ফুরিয়ে আসছে, নিজেও বুঝছেন তবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্টারডম ধরে রাখার।
সাধনার নিয়তি যেন লেখাই হয়ে গিয়েছিল অন্ধত্বে। থাইরয়েডের সমস্যা থেকেই দৃষ্টি হারিয়েছিলেন এক চোখের। কোনও চিকিৎসাই কাজে আসেনি। একসময় কমতে শুরু করল ছবির জন্য অফার আসা। কমতে কমতে একেবারে থেমেও গেল একসময়। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সেই ফেনোমেনন-‘সাধনা’।
তারপর একেবারে অন্তরালে। একবার প্রকাশ্যে এসেছিলেন। এক ফ্যাশন শোয়ে হেঁটেছিলেন রণবীর কাপুরের সঙ্গে। চেহার বদলেছে, রোগ অসুস্থতায় কাবু, কিন্তু কপালের ওপর ফ্রিনংস বলে দেয় তিনিই সেই ‘সাধনা’।
২০১৫’র ডিসেম্বরে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে ভর্তি হন মুম্বইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালে। আর তাঁর ঘরে ফেরা হয়নি।