সাধনা বসুঃ এক সিনেম্যাটিক জীবনের উপাখ্যান

১৯৩০ সালের ১৬ এপ্রিল, মধু বসুর পরিচালনায় নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘দালিয়া’ নাটকটি। এই নাটকের মধ্য দিয়েই মাত্র ষোল বছর বয়সে অভিনয়-জগতে প্রথম পা রেখেছিলেন সাধনা বসু। অভিনেত্রী হিসেবে এই প্রথম আবির্ভাবেই সাধনা যেমন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তেমনি আদায় করে নিয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও। যেমন—

১৭ তারিখের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা লিখেছিলঃ ‘Miss Sadhana Sen, a girl yet in her teens, who appeared in the role of Amina, scored a distinct triumph. Her acting was all that could be desired and she captivated the audience by a graceful display of dances.

১৯ তারিখের ‘শিশির’ পত্রিকা লিখেছিলঃ ‘কুমারী সাধনা সেনের লীলায়িত ছন্দে নৃত্য ও প্রাণঢালা অভিনয় অতি চিত্তাকর্ষক হইয়াছিল।’

৩ মে’র ‘নাচঘর’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিলঃ ‘আমরা যথার্থই বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছি ‘আমিনা’র ভূমিকায় কুমারী সাধনা সেনের অভাবিত নাট্য-নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে। আবৃত্তি, নৃত্য, গীত, মূক ও মুখর ভাবাভিব্যক্তি, তাঁর প্রতিটি জিনিষ হয়েছিল প্রথম শ্রেণীর শিল্প-সাধিকার মত।’

সেই সময়ের পত্রিকায় সাধনাকে ‘সেন’ পদবিতেই দেখা যাচ্ছে, কেননা, তখনও তাঁর বিবাহ হয়নি মধু বসুর সঙ্গে। সাধনা উনিশ শতকের বাগ্মী ও ব্রাহ্মধর্মের প্রবাদপুরুষ কেশবচন্দ্র সেনের নাতনি। তাঁর পিতা সরলচন্দ্র সেন ছিলেন কেশবের চতুর্থ পুত্র।সরলচন্দ্রের দুই মেয়ে, সাধনা ও নীলিনা। দু’জনেই ছোট থেকেই নৃত্যের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন। সাধনার আবার সেই সঙ্গে সঙ্গীতের প্রতিও ব্যাপক আগ্রহ ছিল। সরলচন্দ্র মেয়েদের এই অনুরাগ ও আগ্রহকে প্রশ্রয় দিয়ে তাঁদের সঙ্গীতনৃত্যে সুশিক্ষার বন্দোবস্ত করেছিলেন। একদা এই নৃত্যসূত্রেই আলাপ হয়েছিল সাধনার সঙ্গে মধু বসুর। তখন মধুর বয়স সাতাশ-আঠাশ, আর সাধনার তের-চোদ্দ। বছরের হিসেবে সেটা, ১৯২৭-২৮ সাল। মধু বসু ‘ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ারস’ নামে একটি নাট্যদল গঠন করে সেই সময় ‘আলীবাবা’ নাটকের প্রযোজনা-পরিচালনায় নেমেছিলেন। উদ্দেশ্য, গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের উন্নয়ন ফাণ্ডে কিছু অর্থ তুলে দেওয়া।

নাটকের প্রধান প্রধান চরিত্রসমূহে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়েছিলেন। নিজেও অংশ নিয়েছিলেন অভিনয়ে। মূল পার্ট ভাগাভাগির ব্যাপারটা এভাবেই মিটে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল নাচের দলের মেয়েদের নিয়ে। ‘আলীবাবা’য় মেয়েদের বৃন্দনাচের ভূমিকা অনেক। মুশকিল হল, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে তেমন নাচ জানা মেয়ে কেউই ছিলেন না। এই অবস্থায় মধু বেশ ভাবনায় পড়লেন। ক’দিন দুর্ভাবনায় কাটানোর পর মেজদিকে সবটা জানাতেই তিনি তৎক্ষণাৎ সহায় হলেন। আসলে লতায়পাতায় মেজদির পরিচিত সরলচন্দ্রের পরিবার। মেজদি জানেন তাঁদের বাড়ির দুই নৃত্যপটিয়সী মেয়ের কথা। শুধু পটিয়ে রাজি করাতে পারলেই হল। তাই রাজি করাতেই তিনি মধুকে সঙ্গে নিয়ে একেবারে সরলচন্দ্রের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। সব শুনে উদার সরলচন্দ্র সহজেই অনুমতি দিলেন। তাতে বলা বাহুল্য, মধু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর সাধনাও জীবনে প্রথমবার নাট্যমঞ্চে ওঠার সুযোগ পেয়ে গেলেন। সরলচন্দ্রের বাড়িতে সাধনাকে দেখেই মধুর ভালো লেগেছিল। অমন সুন্দরী ও গুণবতীকে দেখে কার না ভালো লাগে। কিন্তু এক সঙ্গে কাজ করতে করতে উভয়েই উভয়ের আরোও আরোও গুণপনার পরিচয় পেয়ে সেই ভালো লাগা সম্পর্কে সচেতন হলেন। নির্মিত হতে লাগল ভালোবাসার পথ।

মধুর চেয়ে সাধনা ছিলেন ষোল বছরের ছোট। তবুও শিল্পসাধনার পথ বেয়ে তাঁদের ভালোবাসার পথ নির্মিত হতে বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াল না, পরিবারও না। ভালোবাসা বড় সংক্রামক। তাই ‘আলীবাবা’র মধ্য দিয়ে নৃত্য ও সঙ্গীতের অনুরাগী সাধনা মঞ্চকেও ভালোবেসে ফেললেন। কখনও নৃত্যের মাধ্যমে, কখনও নৃত্য পরিকল্পনা ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে, কখনও বা অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চের সঙ্গে, মধুর পরিচালনা ও প্রযোজনার সঙ্গে আমূল জড়িয়ে রইলেন সাধনা। একে একে ‘জেরিনা’, ‘ওমরের স্বপ্নকথা’, ‘বিদ্যুপর্ণা’ প্রভৃতি নৃত্যপ্রধান নাটকে তিনি ধারাবাহিকভাবে অনবদ্য অভিনয় করে গেলেন। মধুর হাত ধরে মঞ্চের পরি তাঁর এই যে ভালোবাসা তৈরি হল, পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও এই মঞ্চাভিনয়কে সাধনা কখনই ত্যাগ করলেন না। ত্যাগ করার কথা ভাবতেও পারলেন না।

Sadhana-Basu-Alibaba

মধু বসুর পরিচালনায় ‘আলীবাবা’ নাটকের মধ্য দিয়ে সাধনার যেমন মঞ্চাভিষেক হয়েছিল, তেমনি ‘আলীবাবা’ ছায়াছবি দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্রে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটল। ১৯৩৭ সালে। প্রধান ভুমিকায়, মর্জিনার চরিত্রে। ছবিটি অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে তাঁকে চলচ্চিত্র নায়িকা হিসেবে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তুলল। তারপর একে একে ‘অভিনয়’ (১৯৩৮), বাংলা ও হিন্দিতে ‘কুমকুম’ (১৯৪০), বাংলা-হিন্দি ও ইংরেজিতে ‘রাজনর্তকী’ (১৯৪১) ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সাধনা সেই জনপ্রিয়তাকে লালন করে গেলেন অতীব যত্নে।

এই সময় মঞ্চাভিনয়, চলচ্চিত্রাভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নিজস্ব নাচের দল নিয়ে সারা বাংলা তো বটেই, সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় করে বেড়ালেন একের পর এক সার্থক শো। মঞ্চে বা চিত্রে অভিনয় ও নৃত্যপরিচালনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না সাধনা। ১৯৪৬ সালে তৈরি করলেন নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা, ‘সাধনা বোস প্রোডাকশন’। দেখা দিলেন নৃত্যপরিচালক ও চিত্রপরিচালকরূপে। প্রযোজনা ও পরিচালনা করলেন ‘অজন্তা’ ছবিটি। রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’ কবিতার ভাব নিয়ে নির্মিত নৃত্যনির্ভর এই ছবি নৃত্য-আমোদী দর্শকদের ভালো লেগেছিল।

Sadhana-Bose-Dance

কিন্তু এ-সব বেশ পরের ঘটনা। শুরুর ঘটনা হচ্ছে, সাধনার বিয়ে। শেষের ঘটনাও। তিনি মধু বসুকে বিয়ে করেছিলেন মাত্র ষোল বছর বয়সে। কেরিয়ারের শুরুতেই। ১৯৩০ সালের ১৫ ডিসেম্বর। অবশ্য প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে, বিয়ে হবে ১৩ ডিসেম্বর। সেই মতো কার্ড ছাপানোর কাজও প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুবান্ধবেরা সকলে মিলে ১৩ তারিখটি অশুভ ঠাউরে আপত্তি জানান, বিয়ের তারিখ বদলাতে পরামর্শ দেন। তারই জেরে শেষমেশ বিয়ের দিন ঠিক হয় ১৫ তারিখ। বিয়ে হয়, ব্রাহ্ম মতে এবং রেজিস্ট্রি করে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ নিয়ে। কিন্তু তারিখ বদল করেও এ বিবাহের অবিতব্য খণ্ডানো যায়নি। সিনেমা জগতের এই দম্পতির দাম্পত্য-পরিণতি ঘটেছিল অগুন্তি পরিচিত সিনেমার গল্পের মতোই। বিচ্ছিন্নতাই হয়েছিল গন্তব্য। ‘সোনার দাগ’ গ্রন্থের লেখক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ বলেছেন, ‘অস্থিরতা, অপর্যাপ্ত খ্যাতি, অর্থ, অবাধ স্বাধীনতা, অগণিত স্তাবক তাঁকে সাময়িকভাবে হলেও সম্পূর্ণ এক বিচ্ছিন্নতার জগতে নিয়ে গিয়েছিল।’

হ্যাঁ, বিচ্ছেদ একদা অবধারিতভাবে নেমে এসেছিল তাঁদের জীবনে। সিনেমার মতোই সাধনা মধুর জীবন থেকে সরে গিয়েছিলেন; তারপর একদিন উপলব্ধির পথ বেয়ে মধুর জীবনে ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু, আসা-যাওয়ার এই বৃত্তে ‘সুখ’ বলতে যা বোঝায়, তা তাঁদের সংসারে কোনদিনই বাসা বাঁধার সুযোগ পায়নি। আসলে, বেঁধে রাখার জন্য যে সামান্য অনুদারতার প্রয়োজন হয়, তা মধুর ছিল না; বেঁধে বেঁধে থাকার জন্য যে উদারতার প্রয়োজন হয়, তা সাধনারও ছিল না।

অ-সুখের এই আক্ষেপটুকু মধু-সাধনারই ছিল, তাঁদেরই থাক। আমাদের থাক, সিনেমায় সাধনার দান…

বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার পরম্পরায় যে শিক্ষিতা, সুন্দরী, ব্যক্তিত্বময়ী, নৃত্য ও সঙ্গীত-পটিয়সী আধুনিক অভিনেত্রীর ধারা দেবিকারানিদের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল, তাকে পুষ্ট করেছেন সাধনা। নাটক ঘেঁষা অভিনয় থেকে চলচ্চিত্রকে মুক্ত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল চার দশকের সিনেমায়, তাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তিনি। উদয়শঙ্কর ১৯৪৮ সালে ব্যালেমুখর ছায়াছবি ‘কল্পনা’ নির্মাণ করে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে নতুন দিগন্ত তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তাঁর আগে ততটা গভীর না-হলেও এই ফর্মে অবদান রেখেছেন সাধনা তাঁর ‘অজন্তা’ চিত্রে। সিনেমা ও সাধনার শতবর্ষ পেরিয়ে তাঁর প্রতিভার এই বহুমুখ, ইতিহাস ভুলবে কেমন করে!...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...