গণেশ পাইনের তুলির জগৎ

দিন কয়েকের ব্যবধানে খিদিরপুরে একটা আর হাতিবাগানে একটা। ১৯৪১-এ দু- দুটো বোমা পড়ল কলকাতায়। অমনি সন্ধ্যে থেকে ভোর, কলকাতা ডুবে গেল ব্ল্যাক আউটের নিকষ অন্ধকারে। অসংখ্য নাগরিকের মনেই তখন ঢুকে গেল জাপানি বোমায় বেঘোরে মৃত্যুর ভয়। সটান তাঁরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিতে লাগলেন দেশগাঁয়ের বাড়িতে।

তখন ছোট্ট গণেশের বয়স মাত্র চার। তাঁদের পালিয়ে যাবার কোন জায়গা ছিল না, ছিল শুধু একটাই ঠিকানা, উত্তর কলকাতায় ক্ষয়ে যাওয়া জরাজীর্ণ বিশাল এক বাড়ি। সেও ব্ল্যাক আউটের আলোছায়ায় হয়ে উঠল প্রবল রহস্যময়। চার বছরের শিশুটির যখন একটু একটু করে এই স্বভাব রহস্যময় পৃথিবীটাকে চিনে নেবার বয়স, ঠিক তখনই তার চারপাশটা দুম করে হয়ে উঠল আরও রহস্যময়। হয়ে উঠল অদ্ভুত আলোআঁধারির এক জগৎ। সেই জগৎ ছাপ রেখে গেল চার বছরের ছেলেটির মনের গভীরের গোপন এক কোনে।

আদ্যিকালের রহস্যমাখা সেই বাড়িরই একটি ঘরে ঠাকুমার কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে ছোট্ট গণেশ যখন তাঁর মুখে ঘুম পাড়ানি গান শুনতেন, শুনতেন ভুত-প্রেত-রাক্ষস-খোক্কসের গল্প; তখন শিরায় শিরায় শিহরণ তুলে তাঁর অনুভূতি মনের ভেতরের জমাট রহস্যময়তাকে আরও কয়েক পরত বাড়িয়ে দিত।

মনে হত এই বাড়িরই অন্ধকার গলিঘুঁজি আর পলেস্তারা খসা ইঁটের পাঁজরে পাঁজরেই গল্পের ঐসব হাড়হিম করা তেনাদের বাস! ঠাকুমার কোল ছেড়ে তখন আর ঘর থেকে বেরতে ইচ্ছে করত না, শুধু ইচ্ছে করত সারাটি রাতের অন্ধকার ঠাকুমার স্নেহের বরাভয় ছায়ায় এমনি করে কাটিয়ে দিতে। ঘরে-বাইরে কত অন্ধকার তখন...

এর কয়েক বছর পর, সেই সব রহস্যময়তার চেয়ে আরও এক গভীর রহস্যের সামিয়ানার তলায় হাজির হয়েছিলেন গণেশ পাইন। দেখেছিলেন মৃত্যুর মতো চরম বাস্তবকে। 

ন' বছর বয়স হতে-না-হতেই দেখেছিলেন ছেচল্লিশের দাঙ্গা। কলকাতার পথে পথে অনাহারী মানুষের মৃত্যুর মিছিল। দেখেছিলেন মন্বন্তর আক্রান্ত গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী মিছিল। 'ফ্যান দাও' বলে হঠাৎ সদর দরজায় উটকো অভুক্ত পেটের কান্না!

ন' বছর বয়সটা একজন ভাবী শিল্পীর কাছে সময়ের ওই ঘা-গুলো চিনে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। এ বয়সের মনের চেয়ে চিরস্থায়ী ক্যানভাস বুঝি আর হয় না। তাই পরবর্তীকালে গণেশ পাইনের আঁকা ছবিতে সেই শৈশবে ছুঁয়ে আসা আলো-অন্ধকারের এত আনাগোনা, এত মৃত্যুর প্রতীকময়তা।

এ তো গেল অন্তরের কথা। কিন্তু, বাইরের আলাপ? সেখানেও রেখা আর অবয়বের গঠনশৈলীতে অনেকের মাঝে আলাদা করে  লহমায় চিনে নেওয়া যায় তাঁর ছবি। সেখানেও সেই শৈশবের ভাঙাচোরা অট্টালিকা ও স্থাপত্যের ছড়াছড়ি। 

গণেশ পাইনের ছবি ও খোদিত চরিত্রের চোখে মর্মর মূর্তির শূন্যতা-স্থবিরতা-নৈর্ব্যক্তিকতা, শরীরে ঔপনিবেশিক ও উত্তর আধুনিক ভোগবাদ, আবার তারই সামনে হাজির হয় কালের করাল হাতছানি। 'কাল' সেখানে এসে দাঁড়ান নানান রূপে।

পিকাসো যেমন একখাতা রেখাছবিতে নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি, গণেশও তেমনি তাঁর ছবিতে অস্থির সময়ের প্রেক্ষিতে কালের সম্মুখে একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে নিজেকে হাজির করে প্রশ্ন করছেন নিজের সৃষ্টি ও অবস্থান নিয়ে।

বেঙ্গল আর্ট কলেজে শিল্পশিক্ষা নিয়ে গণেশ পাইন শুরু করেছিলেন শিল্পী-জীবন। প্রথম থেকেই হল্যাণ্ডের শিল্পী রেমব্রান্টের ছবিতে আলো আর গাঢ় রঙের ব্যবহার গণেশকে প্রবল ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই প্রভাবের মূল কারণ তাঁর অবচেতনাগত। কারণ, শিশু গণেশ পৃথিবীকে চেনার প্রেক্ষাপটে সেই প্রাগাঢ় আলো-অন্ধকারের রহস্যময়তাকেই তো আগে আত্মস্থ করেছিলেন। সেই অনুভূতির পথে তাই রেমব্রান্ট হলেন তাঁর সফর সঙ্গী। সেই সঙ্গে বেঙ্গল আর্ট এর স্কুলিং থেকে পেলেন যামিনী রায়, গগন ও অবন ঠাকুরের লোকশিল্প এবং স্বাদেশিকতার চেতনা।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে একটা দেওয়ালের মতো, যে দেওয়াল ধরে সাহিত্যের পথে তিনি শিশুর মতো হাঁটি হাঁটি পা পা হাঁটতে শিখেছিলেন; তেমনি গণেশও রেমব্রান্ট-যামিনী-গগন-অবনের মতো পূর্বসূরীদের হাত ধরে হাঁটতে শিখে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব সাররিয়াল আলো-আঁধারির এক পথ। যে পথে তিনি এমন একজন স্বতন্ত্র সম্রাট, কালে কালে যাঁর সভায় হাজির হয়েছেন অসংখ্য অনুগামী। একজন প্রকৃত শিল্পীর কাছে এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কি-ই বা হতে পারে?

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...