কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'পথের দাবী' উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি (সব্যসাচী) যে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আদলে তৈরি-এ-কথা বহুল চর্চিত। সব্যসাচী রাসবিহারীর মতোই সুদক্ষ সংগঠক ও নেতা। তাঁর মতোই বহুভাষাবিদ। উপন্যাসে সে গিরিশ মহাপাত্র নামে এক গাঁজাখোর বৃদ্ধের ছদ্মবেশ নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের চোখে চমৎকারভাবে ধুলো দিয়েছিল। এটা আপামর পাঠকের বেশ প্রিয় একটা অধ্যায়। বলা বাহুল্য, সব্যসাচীর এই ছদ্মবেশের দক্ষতাটির মধ্যেও রয়েছে রাসবিহারী বসুর পরোক্ষ অনুপ্রেরণা।
রাসবিহারীর ছদ্মবেশের দক্ষতার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টও দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে লিখেছিলেন, 'লোকটা চাইলে রঙ্গমঞ্চের নামকরা অভিনেতা হতে পারত'।
আসলে, ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাতি, উর্দু প্রভৃতি ভাষায় রাসবিহারী অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আর তার সঙ্গে মেকআপে নিজেকে পাল্টে নেওয়ায় তাঁর জুড়ি ছিল না। এক এক ভাষার প্রদেশের মানুষের কাছে তিনি এক এক নামে পরিচিত ছিলেন। পাঞ্জাবিদের কাছে তিনি 'দরবারা সিং' নামে পরিচিত ছিলেন। আর হিন্দিভাষীদের কাছে পরিচিত ছিলেন 'সতীশচন্দ্র' নামে।
রাসবিহারীর জীবনে ছদ্মবেশের এই প্রয়োজন পড়ল অবশ্য গুপ্ত-বিপ্লবী থেকে ব্যক্ত-বিপ্লবী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই। স্বভাবতই এর একটি ধারাবিবরণী আছে। যথা:
রাসবিহারী তখন দেরাদুন বনবিভাগের সরকারি চাকুরে। সেই সঙ্গে উত্তর ভারতের বিপ্লবী সংগঠনের নেতাও। সেটা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ।
এই সময় কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরিত হতেই সেখানে বিশাল এক সমাবেশের আয়োজন হল। ২৫ ডিসেম্বর দিল্লির চাঁদনি চকের রাস্তায় সেই উপলক্ষে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বিশাল শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন বলে জানা গেল।
সংবাদটি জানার পরই রাসবিহারী পরিকল্পনা করলেন, সেখানেই বোমা মেরে হার্ডিঞ্জকে উড়িয়ে দেবার। সেই মতো বাংলার কিশোর বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসকে মেয়ে সাজিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেললেন। সেখানেই পরিকল্পনামাফিক যথাসময়ে বোমা ছুঁড়লেন বসন্ত। বোমা ফাটলও। কিন্তু হার্ডিঞ্জ মরলেন না, আহত হলেন মাত্র!
যাই হোক, বোমা ফাটতেই যে বিশৃঙ্খল হুটোপাটি ছোটাছুটি শুরু হল, তার সুযোগে বসন্ত ও রাসবিহারী দু'জনেই নির্বিঘ্নে স্বস্থানে ফিরে গেলেন। কিন্তু ভাইসরয়ের ওপর হামলা, এ তো কম কথা না। কাজেই দেশের গোয়েন্দা বাহিনী একযোগে নেমে পড়ল জোরদার তদন্তে। আর তাতেই অচিরে ফাঁস হয়ে গেল এই হামলার পরিকল্পক হিসেবে রাসবিহারীর নাম। এও ফাঁস হয়ে গেল যে, রাসবিহারী বনবিভাগের একজন কর্মী।
গোপনসূত্রে খবর পেয়ে রাসবিহারী অবশ্য আগেভাগেই দেরাদুন ছেড়ে লাহোরে পালিয়ে গেলেন। এবং সেখানে আত্মগোপন করেই ভেঁজে ফেললেন আক্রমণের আর-একটি পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, দিল্লির লরেন্স গার্ডেনে উচ্চপদস্থ ইংরেজদের এক সভায় বসন্তকে আবার বোমা অভিযানে পাঠালেন। অভিযান ব্যর্থ হল। আবারও ফাঁস হয়ে গেল অভিযানের পরিকল্পক রাসবিহারীর নাম। বসন্তও ক'দিনের মধ্যে ধরা পড়লেন। এবং রাসবিহারীর মাথার দাম ঘোষিত হল এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। সময়টা, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ।
শাসকের মুখে তখন একটাই কথা, যে-করেই হোক রাসবিহারীর খোঁজ চাই! তাই, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশের অসংখ্য গুপ্তচর। কিন্তু তাদের সন্ধানী সতর্ক দৃষ্টিও রাসবিহারীকে আটকে রাখতে পারল না। সংগঠনের কাজে তিনি হাজির হলেন কলকাতার বেলেঘাটায়। সমস্ত গোপনীয়তা সত্ত্বেও কিন্তু তাঁর আসার খবর গোপন রইল না পুলিশের কাছে। অমনি গোয়েন্দারা পুলিশবাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলল সমস্ত এলাকা। পাক্কা খবর পেয়েই তারা এসেছে। তবু রাসবিহারী বা কোন বিপ্লবীর টিঁকিও ছুঁতে পারল না তারা।
শুধু তাই নয়, সন্দেহজনক বাড়িটাতেও কাউকে খুঁজে পেল না। শুধু দেখতে পেল, বাড়িটার পাশে একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা অ্যাঙ্লো ইন্ডিয়ান বসে খালি একমনে ভায়োলিন বাজিয়ে চলেছে। স্বভাব সন্দেহে গোয়েন্দারা লোকটাকে দেখল বটে। কিন্তু কোন এঙ্গেল থেকেই তাকে ভারতীয়, কিংবা যুবক, অথবা বিপ্লবী-কোনটাই মনে হল না। কাজেই নাক তুলে হতাশার ঘাম মুছে তারা চলে গেল।
এদিকে তারা চলে যেতেই সেই অ্যাঙ্লো ইন্ডিয়ান বেহালাবাদকের বাজনা থামল। ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা গেল। এই হাসি, মহার্ঘ আত্মবিশ্বাসের জন্য। নিখুঁত ছদ্মবেশের জন্য। কেননা, এ-দুয়ের সমন্বয়েই ইংরেজের অভ্যস্ত চোখও ধরতে পারল না নকল অ্যাঙ্লো ইন্ডিয়ানকে, চিনতে পারল না তার আড়ালের বিপ্লবী রাসবিহারীকে। শুধু এই একবার নয়, এভাবেই নিখুঁত ছদ্মবেশে বারে বারে তিনি ইংরেজ শক্তির চোখে ধুলো দিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়ে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সংগঠনের কাজ।
এরই মধ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই তার আবহে ইংরেজকে নাস্তানাবুদ করে স্বদেশ থেকে তাড়াতে দেশব্যাপী ব্যাপক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে ফেললেন রাসবিহারী। দেশের সমস্ত বড় বড় বিপ্লবী নেতারা তাঁর এই পরিকল্পনায় একমত হলেন। কিন্তু পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার আগেই কিছু দেশদ্রোহীর বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পড়ে গেলেন বেশ কয়েকজন তাবড় তাবড় নেতা। ফলে, তাঁদের অভাবে পরিকল্পনাও মুখ থুবড়ে পড়ল। আর এর সঙ্গেই প্রধান পরিকল্পক রাসবিহারীকেও ধরার জন্য পাঁচগুণ শক্তি বাড়িয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেল।
অবস্থা যখন চরমে উঠল, তখন রাসবিহারী দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করলেন। ঠিক করলেন, কোন স্বাধীন দেশে গিয়ে তাদের সাহায্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করবেন। চারিদিকে সেই মুহূর্তে ব্রিটিশের গুপ্তচরের সজাগ দৃষ্টি, তন্ন তন্ন করে তাঁকে পুলিশ খুঁজছে হন্যে হয়ে, বিশ্বাসঘাতকেরাও দিকে দিকে প্রস্তুত; রাসবিহারী জানেন, এরই মাঝে পালাতে গেলে ছদ্মবেশে অসাধারণ এক কূটকৌশলে পালাতে হবে।
ব্যস, তিনি ভাবলেন আর এভাবে দেশ ছাড়ার সুযোগও ঘটে গেল। এ-ব্যাপারে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন ঠাকুরবাড়ির সুরেন ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ জাপানে যাচ্ছেন, সঙ্গী হিসেবে একজন সেক্রেটারির প্রয়োজন। তিনিই 'পি এন ঠাকুর' নামে রাসবিহারীর পাসপোর্ট বানিয়ে দিলেন। পাকা করে দিলেন যাত্রার বন্দোবস্ত।
নির্দিষ্ট দিনে কবির সঙ্গে জাহাজে চেপে বসলেন রাসবিহারী। শেষ মুহূর্তে তার খবর কিন্তু জেনে ফেলল গুপ্তচরবাহিনী। অমনি সদলে জাহাজে হানা দিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। পুরো জাহাজ খানাতল্লাশি হল, কিন্তু রাসবিহারীর কোন হদিশ কোথাও মিলল না।
আসলে, টেগার্ট সব জায়গা খুঁজলেও দু'টি জায়গায় কিন্তু তল্লাশি করলেন না। এক কবি রবীন্দ্রনাথের কেবিন, অন্যটি তাঁর সেক্রেটারির কেবিন। কবি যে রাজদ্রোহের কাজ করবেন না, এটুকু ভরসা তাঁর কবির প্রতি ছিল। ছিল, কেননা, এই জাহাজে করে রাসবিহারী যে দেশত্যাগ করছেন, এই খবর টেগার্ট পেয়েছিলেন; কোন ছদ্মবেশ নিয়েছেন, সে-খবর পাননি। তবে, কেবিনে ঢুকলেও তিনি রাসবিহারীকে নিশ্চিত ধরতে পারতেন না। সেখানে নিখুঁত ছদ্মবেশে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে এক হাতে বই অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে রাসবিহারী অনন্য অভিনয়ের জন্য কিন্তু অপেক্ষাই করছিলেন...
যাই হোক, জাপানে পৌঁছতে এরপর রাসবিহারীকে আর-কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। সেখানেও আত্মগোপন করে তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন, সংগঠন তৈরি করতে থাকেন। বলা বাহুল্য, এসব কথা সকলেই জানেন। তবে অনেকেই জানেন না যে, আমৃত্যু প্রবলভাবে সক্রিয় বিপ্লবী নেতা হয়েও তিনি কোনদিন পুলিশের জালে ধরা পড়েননি, কারাবাস করেননি; আর এসব সম্ভব হয়েছে তাঁর দারুণ উপস্থিত বুদ্ধি, সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা, অসম সাহস আর নিখুঁত ছদ্মবেশধারণের ক্ষমতার জন্যই...