উনিশ শতকে এক রাম (রামনিধি গুপ্ত) বঙ্গে টপ্পার প্রবর্তন করলেন, গান লিখলেন, সুর দিলেন; অপর রাম (রামকুমার চট্টোপাধ্যায়) তাকে হারিয়ে যেতে দিলেন না, বিশ শতকেও বহাল তবিয়তে লালনপালন করে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন। তাই পাড়ায়-জলসায় দ্বিতীয় রামকে দেখলেই লোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলত, ওই দ্যাখো, টপ্পাগায়ক রামবাবু যাচ্ছেন!
হ্যাঁ, 'রামবাবু'। নামের সঙ্গে 'বাবু' শব্দটা এ-যুগে তাঁকেই মানায়। শুধু টপ্পাই নয়, উনিশ শতকের তামাম মজলিসী গানের ভাণ্ডারী ছিলেন রামকুমার। ব্যাকব্রাস চুল, চুনোট ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি, কাঁধে উত্তরীয়, শাল-সজ্জায় তাম্বুলরাঙা ঠোঁটে তিনি যখন আসরে হারমোনিয়াম টেনে বসতেন, তখন এক লহমায় পরিবেশ-প্রতিবেশে উনিশ শতক যেন তার রঙ লাগিয়ে দিত। গানের ভাঁজে ভাঁজে তিনি বলে যেতেন সেই সময়ের গল্প, যা আমাদের পৌঁছে দিত ফেলে আসা দিনগুলোতে।
অর্থাৎ, রামকুমার হলেন আমাদের ফেলে আসা হারিয়ে যাওয়া, অথচ ছুঁতে চাওয়া দিনগুলোর গীতিময় ডাক-পিয়ন। আবহমানের সুরেলা রানার।
১৯৮৩ সালে পরিচালক তরুণ মজুমদার রামনিধি গুপ্ত অর্থাৎ নিধুবাবুর জীবন অবলম্বনে 'অমর গীতি' ছবিটি যখন করছেন, তখন ছবিতে নিধুবাবু চরিত্রের লিপে টপ্পা গাওয়ার জন্য রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কারও কথা ভাবাই যায়নি।
এমন তো নয় যে, রামকুমার ছাড়া টপ্পা আর কেউ এ-কালে গাইছিলেন না। রেকর্ডের আদি যুগে গওহরজান থেকে শুরু করে অনেকেই টপ্পা গেয়েছেন; কিন্তু টপ্পাগায়ক হিসেবে রামকুমারের মতো এমন সুখ্যাতি কেউ পাননি, টপ্পার সঙ্গে সমার্থকও কেউ হননি।
অথচ এই টপ্পাই একদা রামকুমার গাইতে চাননি। তিনি তখন অবশ্য নিতান্তই বালক। থাকেন উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায়। সে-বাড়িতে এনায়েত খাঁ সাহেব, ছোটে খাঁ সাহেবের মতো মস্ত বড় বড় সব ওস্তাদ বাজিয়ে-গাইয়েদের নিত্য আনাগোনা।
কারণ, রামকুমারের পিতামহ ছিলেন সঙ্গীত জগতের গুণী মানুষ। বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী ও ভালো তবলচি। সেই সঙ্গে ভালোবাসতেন টপ্পা গাইতে। তা, দাদুর কাছেই নাতির তবলায় হাতেখড়ি হয়েছিল, সঙ্গীতেও। কিন্তু, নাতি রামকুমারের যতটা ভালো লাগত তবলা বাজাতে, গান ততটা না।
তবু, পিতামহ টপ্পা গাইতে গাইতে কথা ছেড়ে সুর তুলতেন, আর পৌত্রকে বলতেন, গান ধরতে। রামকুমারের তখন বয়স অল্প; আদিরসের ভাবওয়ালা গান তাঁর একটুও ভালো লাগত না। তাই নাক সিঁটকে বলতেন, 'দূর, এগুলো ভদ্রলোকের গান নাকি, কেউ গায়!', আর তারপরই পালিয়ে যেতেন।
প্রকৃতির কী অদ্ভুত যোগ, যে-গান হতে তিনি দূরে সরে সরে থাকতেন, সেই গানই একদিন তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধল। আসলে, পিতামহের কণ্ঠে এই সব পুরাতনী গান নিত্য শুনতে শুনতেই একদিন তাদের ভালোবেসে ফেললেন।
তখন পিতামহের তালিম শেষ করে বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতাচার্য যতীন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে নাড়া বাঁধলেন। আর, কালোবাবু অর্থাৎ প্রসিদ্ধ টপ্পাগায়ক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শিখতে লাগলেন টপ্পা। এঁরা সকলেই ছিলেন রামবাবুর পিতামহের সুহৃদ।
গান না-গেয়ে শুধু তবলচি হয়েও বিখ্যাত হতে পারতেন রামকুমার। তবলায় তিনি বেনারসের বিখ্যাত বুন্দিপ্রসাদ মিশ্রের শিষ্য। ছোট থেকেই তাঁর হাত ও কান তালে-লয়ে-সুরে এমন তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, বড় বড় ওস্তাদেরাও তাঁর সঙ্গতে আসর জমাতেন নির্দ্বিধায় ও অবলীলায়।
তখন তাঁর মাত্র আট বছর বয়স। বিডন স্ট্রিটের কালী মিত্রের বাড়িতে মজলিসী আসর বসেছে। তাতে ওস্তাদ এনায়েত খাঁ-সাহেব সেতার বাজাবেন; আর ওস্তাদ ছোটে খাঁ-সাহেব বাজাবেন সারেঙ্গি। এঁরা দুজনেই রামকুমারের পিতামহের বন্ধু। রামকুমারকে খুব স্নেহ করেন।
তা, বন্ধুর কাছে দুই ওস্তাদ যখন শুনলেন যে, নাতিসাহেব তৈরি হয়ে উঠেছেন; তখন টেনে একেবারে আসরের তবলায় বসিয়ে দিলেন। ওই বয়সেও রামকুমারের মনে ভয়ডর বলে কিছু এল না। তিনি নির্দ্বিধায় বসে, নির্বিঘ্নে আসর জমিয়ে দিলেন। দুই বড় ওস্তাদের সঙ্গে টরেটক্কা পাল্লায় তিনি এমন মিষ্টি বাজালেন যে, উপস্থিত সকলেই বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তারিফের পাহাড় শেষ হতে চাইল না।
তারপর কত কত আসরে কত যে বিখ্যাত বিখ্যাত সব সঙ্গীতজ্ঞ-গাইয়ের সঙ্গে তবলা বাজালেন, তার ইয়ত্তা নেই। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কাজী নজরুল--সেকালের দিকপালদের মধ্যে কে নেই সেই তালিকায়! তখন রেডিওতে নববর্ষ, দুগ্গাপুজো, বড়দিন প্রভৃতি উপলক্ষে স্টেজ-প্রোগ্রামের মতো করে জলসা হত। সেই সব জলসাতেও কত বার তবলা বাজিয়েছেন রামকুমার।
তখন 'আকাশবাণী' ছিল গারস্টিন প্লেসের বাড়িতে। একদিন সেখানকার বাঁধা কণ্ঠশিল্পীও হয়ে উঠলেন তিনি। যোগাযোগের হোতা হলেন অবশ্য দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। এই রসিক ও গুণী মানুষটিরও অগাধ স্নেহ পেয়েছেন রামকুমার।
তবলা বাজানোর পাশাপাশি এই সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-টপ্পা-পুরাতনী প্রভৃতি গান আসরে-জলসায় রামকুমার যখন গাইছেন, তখন সুযোগ এল প্রথম রেকর্ড করার। মজার কথা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নয়, টপ্পা-পুরাতনীও নয়; প্রথম রেকর্ড হল কিন্তু আধুনিক গানের। ১৯৪৫ সালে। তখন তাঁর তেইশ-চব্বিশ বছর বয়স।
গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত এ-রেকর্ডে এপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে গান ছিল দুটি। কমল দাশগুপ্তের সুরে 'জাগিতে এসেছি রাতি' এবং 'তোমার আমার মিলন'। প্রথমটি সেকালের বিখ্যাত গীতিকার প্রণব রায়ের লেখা, দ্বিতীয়টির লেখক স্বনামধন্য মোহিনী চৌধুরী।
কে এল সায়গল তখন হিন্দি ও বাংলা গানের জগতে এক অনুকরণীয় গায়ক। উঠতি গায়কেরা তাঁকে সে-সময় অনেকেই অনুকরণ করছিলেন। যুগের প্রভাবে প্রথম রেকর্ডের গান দুটিতেও রামকুমাররের স্বরে-গায়কীতে সায়গলের ছাপ স্পষ্ট। তবে, কথা, সুর ও গায়কের নিবেদনে রেকর্ডটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে, রামকুমারের পেশাদার গায়ক হয়ে ওঠার পথটিকে প্রশস্ত করল ।
অভাবনীয় এই সাফল্য থেকেই রামকুমারের শিল্পীসত্তা যন্ত্র ছেড়ে কণ্ঠ সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকল। তখন সায়গলের প্রভাব কাটিয়ে তিনি ধীরে ধীরে নিজস্বতাকে খুঁজে নিলেন। আধুনিক নয়, টপ্পা-পুরাতনী-ভক্তিগীতির ধারাটিকে নিজস্ব ধারা বলে গ্রহণ করলেন; তৈরি করলেন নিজস্ব পথ। আর সেই পথ ধরেই তিনি হয়ে উঠলেন বাংলার একটি বিশিষ্ট যুগের প্রতিনিধি, হয়ে উঠলেন হারানো সঙ্গীত ও সংস্কৃতির সূত্রধার...
তথ্যঋণ : রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন ভিডিও সাক্ষাৎকার।