রামানন্দ-রবীন্দ্রের বন্ধুত্ব ও অভিমানের উপাখ্যান

কবিতা? হ্যাঁ তাও লিখেছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। মাত্র একবারই। দশ বছর বয়সে। তিনি তখন বাংলা স্কুলের ছাত্র। স্কুলে হল কবিতা রচনার প্রতিযোগিতা। কবিতার বিষয়, 'বাঁকুড়ার স্বাভাবিক সৌন্দর্য'। এ আর বেশি কী? বাঁকুড়ার পাঠক পাড়ায় তাঁর জন্ম। মাইলের পর মাইল হেঁটে কতবার বন-জঙ্গল-লাল মাটি-ঘিয়ে মাটির মাঠ পেরিয়ে বলরামপুরে মামার বাড়ি গেছেন। ঘরের বাইরে দুই পা দূরে শুশুনিয়া। সেখানকার পাহাড়-কন্দরে বেড়াতে গেছেন। মাঠেঘাটে জংলা ফুল তুলেছেন, পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটেছেন। তাঁর বয়সে এর চেয়ে বেশি এ রুখা দেশের স্বভাবিক সৌন্দর্য আর দেখেছে ক'জন? কাজেই এই দেখাকে কবিতার ছন্দে বাঁধতে অসুবিধা হল না। আর সেই অনায়াস লেখাটিই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে গেল। দশ বছর বয়সে তিনি পেলেন দশ টাকা, প্রথম পুরস্কার। লোকে পুরস্কার পেয়ে এমন উৎসাহিত হয় যে, তেড়ে কবিতা লিখতে শুরু করে; কিন্তু, রামানন্দের কী হল কে জানে, সারাজীবনে আর একটাও কবিতা লিখলেন না! পরিণত বয়সে এই নিয়ে খেদও অবশ্য হয়েছিল মনে। রসিক রবীন্দ্রনাথ তখন সরস মন্তব্যে বলেছিলেন, "মশায়, আপনি দশ বছরেই পুরস্কার পেয়ে গেলেন বলেই ত আপনার আর জীবনে কবিতা লেখা হল না। আমি পঞ্চাশ বছরের আগে কোনোই পুরস্কার পাইনি বলে আজীবন কবিতাই লিখে গেলাম।"

কবি হয়তো হতে পারেননি রামানন্দ, কিন্তু, সাংবাদিক হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে, মানবদরদী ও দেশহিতৈষী হিসেবে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তার তুলনা পাওয়া ভার। তাঁর 'প্রবাসী' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের অনেক রচনাই প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের জন্য স্বতন্ত্র পৃষ্ঠা বরাদ্দ হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের মত ও পথ প্রচারিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধতার প্রতিবাদ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এতটাই স্পর্শকাতর ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন রামানন্দ। বলেছিলেন, 'Rabindranath for ever এই আমার motto." তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দের মধ্যে লেখক ও সম্পাদকের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর সখ্যতায় উন্নীত হয়েছে। সম্পাদক রামানন্দের পৃষ্ঠপোষণ ও তাড়নাতেই রবীন্দ্রনাথ 'গোরা' লিখেছিলেন। কবিতা, গান ও ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে যত সহজে লেখানো যেত, উপন্যাস তত সহজে নয়। ফলে, রামানন্দ সে-বার তাড়নার পরত বাড়াতে অগ্রিম তিনশো টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আর, সেই সদ্য নগদ শোধ করতে রবীন্দ্রনাথকে অগত্যা কলম ধরতে হল। আড়াই বছর ধরে 'প্রবাসী'তে চলল ধারাবাহিক উপন্যাস, 'গোরা'। এভাবেই একদা রামানন্দ কবিকে দিয়েই অনুবাদ করিয়ে নিয়েছিলেন 'গীতাঞ্জলি'-র কবিতাগুলি। রামানন্দ চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা যাতে স্কুল ও কলেজে পাঠ্য হয়ে ওঠে। চেষ্টাও করছিলেন। আর এই ভাবনা থেকেই রবীন্দ্ররচনার সংকলন, 'পাঠসঞ্চয়' বইটি পরিকল্পনা ও প্রকাশ করলেন। কিন্তু, অনেক দরবার করেও তা ছাত্রপাঠ্য করে তুলতে পারলেন না। শেষমেশ, প্রকাশনার লোকসান লাঘব করতে তা শুধুমাত্র বিশ্বভারতীতে ছাত্রপাঠ্য করতে হল। 

১৯৩১ সাল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এমএ'র প্রশ্নপত্রের দুটি প্রশ্ন নিয়ে রামানন্দ তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন 'প্রবাসী'র পাতায়। দুটি প্রশ্ন উদাহরণ হিসেবে তুলে দেখালেন: "বাংলা গদ্য লিখন রীতির বিকাশ ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত অনুশীলিতব্য করায় এবং বাংলা সাহিত্যের উপর পাশ্চাত্য জ্ঞানানুশীলনের প্রভাব ১৮৮০ সাল পর্যন্ত অনুশীলিতব্য করায় কার্যতঃ রবিবাবু ৪র্থ প্রশ্নপত্রের সমুদয় বিষয় হইতে বাদ পড়িলেন।" রামানন্দ বুঝেছিলেন পুরো ব্যাপারটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাই কোন প্রশ্নেই রবীন্দ্রনাথকে ছোঁয়া হয়নি! এ ক্ষোভের মধ্যে যে শুধু তাঁর রবীন্দ্রপ্রীতি কাজ করেছে এমন নয়, তাঁর ক্ষোভ ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হল বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়কে চেপে রাখার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে।

রবীন্দ্রনাথ রামানন্দর চেয়ে বছর চারেকের বড়। তবু রামানন্দকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। রামানন্দের স্থিতধী, মননশীলতা এবং পণ্ডিত্যের জন্য। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় থাকলে প্রায়ই হেঁটে চলে আসতেন 'প্রবাসী'-র ছোট্ট অফিসে। অফিস তখন 'সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ'-এর ঠিক পাশেই। কাজেই দূর বেশি নয়। কোন রাজনৈতিক প্রতিবাদ করার আগে বা বিতর্কের উত্তর দেওয়ার আগে তিনি অবশ্যই রামানন্দের সঙ্গে আলোচনা করতেন। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যার প্রতিবাদ ও 'স্যার' উপাধি ত্যাগের আগেও তার অন্যথা হয়নি। দেশহিতৈষী রামানন্দও এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন 'প্রবাসী'র পাতায়। 

রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দের এই প্রীতি সম্পর্কে একদা ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। সেই ভুলের শুরু ও শেষ অবশ্য রবীন্দ্রনাথেই। ১৯১৩-য় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাচ্ছেন-এই খবর যখন রটল, তখন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ও নিন্দুক নির্বিশেষে সবাই খুব উদ্বেল হয়ে উঠল। ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসুকে সভাপতি করে সবাই ট্রেনে করে শান্তিনিকেতনে গেলেন কবিকে সংবর্ধনা জানাতে। রামানন্দ তো গেলেনই। কিন্তু, সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ এমন কড়া একখানা ভাষণ দিলেন যে, এই প্রীতি-সংবর্ধনার বিরুদ্ধে সেটি ভর্ৎসনার মতো শোনাল। বিদেশি পুরস্কার পাবার আগে তাঁকে যে কেউ এদেশে সমাদর করল না, চিনল না এবং নিন্দাই করে গেল-এই ছিল তাঁর বক্তব্য। আর এই বক্তব্যেই আঘাত পেলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুরা। তাঁরা অপমানিত বোধ করে ফিরে এলেন কলকাতায়। এর পর বিরুদ্ধবাদীদের কাছে তাঁদের যেন আর মাথা তুলবার জো রইল না, তাদের বিরুদ্ধতার উত্তর দেবার ভাষা রইল না। তবে মন্দের ভালো, দিনদুয়েকের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করলেন যে, একটা গোলমাল তিনি করেই ফেলেছেন নিশ্চয় এবং সেটা ভালো কাজ হয়নি। তখন শুরু হল তাঁর অস্থির অনুশোচনা। তার ফলে যা হল, সেটি রামানন্দকন্যা শান্তা দেবী তাঁর 'রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও অৰ্দ্ধশতাব্দীর বাংলা' গ্রন্থে জানিয়েছেন: 'তিনি ২৫সেই রামানন্দের ক্ষুদ্র বাসায় আসিয়া হাজির। ছোট বড় সকলকে ডাকিয়া খবর লইলেন। সেদিন যে উত্তেজনার বশে তাঁহাদের দেখেন নাই, স্বীকার করেন নাই--ইহার জন্য দুঃখ প্রকারান্তরে জানাইয়া দিলেন। রামানন্দ তাঁহাকে স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, "আমাদের চেয়ে আপনাকে বাহিরের কোন লোক বা জাতি বেশী ভালবাসিতে পারে ইহা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিব না।" রবীন্দ্রনাথ পরাজিত হইয়া বলিলেন, "আপনার কিম্বা জগদীশ প্রভৃতির কথা আমি বলিনি।" কবি তাহার পর রামেন্দ্রসুন্দরের বাড়ীর দিকে যাত্রা করিলেন। বন্ধুদের বাড়ী বাড়ী গিয়া বোধ হয় তাঁহাকে অভিমান ভাঙ্গাইতে হইয়াছিল।' রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেছিলেন ভুল করলে বন্ধুর কাছেও নতজানু হতে হয়, তাতে কোন অপমান নেই, তাতে কোন ক্ষুদ্রতার অভিমান নেই। রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ-দুজনের মধ্যেই এই উদারতা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তাই এ-পথেই দুই বন্ধুতে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছিল আজীবনের মতো এবং উদার রামানন্দ ঘোষণা করেছিলেন, 'আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব লাভ।'



তথ্যঋণ : 'রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও অৰ্দ্ধশতাব্দীর বাংলা' - শান্তা দেবী; 'কোরক' - রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা - ২০১৫।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...