ইতিহাসের আবিষ্কারক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে পুরাতাত্ত্বিক-সাহিত্যিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে যখন মারা যান, তখন ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার জুন সংখ্যায় ঐতিহাসিক কাশীপ্রসাদ লিখেছিলেন যে, পুরাতত্বচর্চায় ‘দশজন প্রথিতমেধা যে অবদান চেষ্টা করলে হয়তো রাখতে পারতেন বা পারতেন না; সেই অবদান একা রেখেছেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।’ কথাটা শতভাগ সত্য। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা বিরাট প্রতিভাবান ও অসাধারণ কর্মবীর না-হলে সম্ভব হত না।

সেকারণেই, ভারতের পুরাতত্ত্বচর্চার ইতিহাসে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম গর্বের সরণিতে সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় আজও। পুরাতত্ত্বচর্চায় তাঁর ঝোঁক তৈরি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ.এ পড়তে এসে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী—কলেজের এই দুই অধ্যাপকের সান্নিধ্যে ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি ব্যাপক কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। শুরু করেন গভীর চর্চা।

চর্চা শুধু পুঁথিতেই থেমে থাকে না। শিলালিপির পাঠ শিখতে ভারতীয় জাদুঘরে নিত্য যাতায়াত শুরু করেন। বিখ্যাত লিপি বিশেষজ্ঞ ড. থিওডোর ব্লখ ছিলেন এই সময় সেখানকার অধ্যক্ষ। রাখালদাসের অনুসন্ধিৎসা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বেশ যত্নের সঙ্গে রাখালদাসকে লিপি পাঠের শিক্ষা দিতে থাকেন।

ব্লখের শিক্ষা ও আপন মেধায় তিনি বছর তিনেকের মধ্যেই অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। চর্চার সূত্র ধরে স্নাতক হওয়ার আগেই শক-কুষাণ যুগের ওপর বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হন। কিছুকাল পরে তাঁর তথ্যের আলোকেই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ স্বরচিত ‘আর্লি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটি সংশোধন করেন। ইতোমধ্যে পুরাতত্ব, প্রাচীন মুদ্রা ও লিপি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে পণ্ডিত সমাজে রাখালদাস সুবিখ্যাত হয়ে ওঠেন।

শুধু তাই নয়, প্রাচীন মুদ্রা বিষয়ে তিনিই প্রথম বাংলা তথা ভারতীয় ভাষায় মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সেই গ্রন্থের নাম, ‘প্রাচীন মুদ্রা’; প্রকাশিত হয় ১৩২২ বঙ্গাব্দে। কুলপঞ্জিকাকে ‘ইতিহাস’ বলে চালানোর যুগে তিনিই প্রথম বাংলায় বিজ্ঞান-সম্মতভাবে ইতিহাস রচনার সূত্রপাত ঘটান ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ রচনার মধ্য দিয়ে।

আমরা সকলেই জানি যে, মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার তাঁর মহৎ কীর্তি। আসলে তিনি যেখানে যেতেন, সেখানেই তাঁর অনুসন্ধিৎসু চোখ ইতিহাসের অবহেলিত অধ্যায়গুলিকে ঠিক খুঁজে নিত।

এই যেমন সে-বার, দিন-দুয়েকের জন্য ঢাকা গিয়েছেন রাখালদাস, এক সেমিনারে যোগ দিতে। যেখানে সেমিনার, সেই নর্থব্রুক হলের কাছেই একটি চণ্ডীমূর্তি বহুযুগ ধরে স্থানীয়দের দ্বারা পূজিত হয়ে আসছিল। তাঁর আগে এই হলে কতবার কত ঐতিহাসিক এসেছেন, কিন্তু কখনও কারও আগ্রহ জাগেনি এই মূর্তিটির প্রতি। কিন্তু রাখালদাস লহমায় আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যে, মূর্তিটি লক্ষ্মণ সেনের আমলের। কেননা, তাতে উৎকীর্ণ একটি শিলালিপিতে ছিল তারই সাক্ষ্য।

বিভিন্ন সময়ে স্বদেশের অবহেলিত প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে তিনি অনেক মূল্যবান ইতিহাস তুলে এনে ভারতের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। পাহাড়পুর ও মিথ কণ্টকিত গয়ার বুক চিরে ইতিহাস তুলে আনার কৃতিত্ব তাঁরই।

তাছাড়া, সাধারণের কাছে প্রত্নবস্তুকে শিক্ষার বস্তু করে তুলতেও তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। সুযোগ পেয়ে বম্বে মিউজিয়ামের প্রত্নতত্ববিভাগ তিনি নিজের হাতে তৈরি করেন। মাত্র তিন মাসে এশিয়াটিক সোসাইটির ক্যাটালগ তৈরি করে দেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে সকল বিদ্যোৎসাহীর জন্য উন্মুক্ত করার কাজে গুরু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও রামেন্দ্রসুন্দরের বিরুদ্ধতা করতেও তাঁর বাধেনি। ইতিহাস চর্চায় ভালোবাসা ও উদারতা তাঁর এমনই আন্তরিক ছিল।

ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থাবলীর পাশাপাশি সাধারণকে ইতিহাসের শিক্ষা দিতে তিনি বেশ কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছিলেন। তার মধ্যে ‘শশাঙ্ক’ (১৯১৪), ‘ধর্মপাল’ (১৯১৫), ‘ময়ূখ’ (১৯১৬), অসীম, করুণা, ধ্রুবা প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

উপন্যাসগুলি পত্রিকায় যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত, তখন আপামর পাঠক অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে থাকতেন পরের কিস্তি পড়ার জন্য—এমনই ছিল তাঁর লেখার প্রসাদগুণ। তাই ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে ড. সুকুমার সেন বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর প্রথমে উপন্যাসক্ষেত্রে নবাগতের মধ্যে দুইজন অসাধারণত্ব দেখাইয়াছেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৩০) ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।… যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস বলিতে যাহা বুঝায় তাহা বাঙ্গালায় একমাত্র রাখালদাসই লিখিয়াছেন।’

ইতিহাসচর্চার বহুধাক্ষেত্রে রাখালদাসের এই যে এত সাফল্য, অনেক সহকর্মীরই তা সহ্য হয়নি। তারা চক্রান্ত করেছে তাঁর সুখ্যাতিকে সুকৃতিকে নষ্ট করে দেওয়ার। এবং অনেকটাই সফল হয়েছে।

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ। রাখালদাস তখন ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগের কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ।  এখানেই একদিন জব্বলপুরের চৌষট্টিযোগিনী মন্দির থেকে একটি মূর্তি চুরি করার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। আনা হয় অর্থ তছরুপের অভিযোগ। মধ্যপ্রদেশ সরকার তাঁকে গ্রেফতারের ওয়ারেন্ট বার করে। কাজ থেকে তাঁকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না-হলেও নিছক সন্দেহের আগুন জিইয়ে রেখে সামান্য পেনশনের বিনিময়ে তাঁকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়।

শুধু শেষ সময় নয়, ব্যক্তিজীবনটা যৌবন থেকেই বড় দুর্ভাগ্যের ছিল রাখালদাসের। মুর্শিদাবাদের উকিল মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতুল ধনসম্পত্তির মাঝে বড় আদরে ছেলেবেলাটা কেটেছে তাঁর, সোনার চামচ মুখে দিয়ে। তাঁর আবদার পূরণ না-হলে যখন-তখন টাকার বাণ্ডিল ছিঁড়ে ফেলতেন, কেউ কিচ্ছু বলত না। ইয়ার-বন্ধুদের ভোজ দিয়ে হামেশাই মুঠো মুঠো টাকা ওড়াতেন। রাজার মতো বখশিস দিতেন। বাজে খরচে সংযম আনতে শেখেননি। পরে সেটাই কাল হয়েছিল।

কেননা, কলকাতায় পড়তে আসার পরই বাবা-মা প্রায় একইসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। দীর্ঘ শরিকি বিবাদ পড়াশুনোয় ছেদ ঘটিয়ে তাঁকে একেবারে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। সম্পত্তির অনেকটা খুইয়ে ফের পড়াশুনোয় নিজেকে বহাল করেছিলেন। মেধা ও পাণ্ডিত্যের জোরে অল্প বয়সে চাকরি পেয়ে খানিক অর্থের অভাব অবশ্য ঘুচেছিল। কিন্তু জ্যেষ্ঠপুত্রের অকাল মৃত্যু তাঁকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল। তার ওপর অপবাদ ও অসম্মান তাঁকে সবদিক দিয়ে শেষ করে দিয়েছিল।

চাকরিটা চলে যাওয়ার পর রাখালদাস ক্রমাগত অর্থকষ্ট ও অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে সিমলা স্ট্রিটের বাড়িটাও একসময় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তিনি যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন স্ত্রী ও কনিষ্ঠপুত্রের জন্য শেষ আশ্রয়টুকুও রেখে যেতে পারেননি…

এই বঙ্গভূমে এত বড় একটি প্রতিভা সেদিন এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল…

 

তথ্যঋণঃ

গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ প্রবন্ধ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...