রাধারাণী এক অগ্নিবিপ্লবের নাম

বয়স কুড়ির ঘরে। তরুণী বিধবা। রবীন্দ্রচর্চার এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখলেন রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে। চেনা ছকের চেনা কথা নয়, বরং খানিক অন্যরকম। তাঁর কথা নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলা সাহিত্যিক মহলের ভিত। প্রায় অপরিচিত তরুণী বিধবার কথায় ঝড় বয়েছিল পক্ষে-বিপক্ষে। তবে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং পছন্দ করেছিলেন তাঁর বক্তব্য।

সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। তাঁর সঙ্গে দেখাটা অবশ্য ঘটনার অনেক আগেই। বাবার হাত ধরে দেখা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কবির সঙ্গে তাঁর সেই যোগাযোগ আজীবন ছিল। রবির বানীই তাঁর আজীবনের পুণ্যশ্লোক।

 সব পড়াশোনা বাড়িতেই। কোনোদিন স্কুলে যাননি। কলেজ, ইউনিভার্সিটি যাননি। কিন্তু তিনি পান্ডিত্যের আধার। বাংলায় নারী সাহিত্যের এক ‘কাল্ট ফিগার’। রাধারাণী দেবী। সাহিত্যের ভুবনে যাঁর অন্য পরিচয় ‘অপরাজিতা’।

জন্ম কোচবিহারে। বাবা ছিলেন কোচবিহারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ছেলেমেয়েদের গান, লেখাপড়ায় বড় করে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মুক্তভাবনার ধারা রুদ্ধ হয়ে যেত অন্দরমহলের দাবীর কাছে। 

তাই ত্রয়োদশী রাধার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল বাড়িতে। সম্বন্ধ করে বিয়ে। কোচবিহার ছেড়ে চলে আসতে হল কলকাতায়। স্বামী পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।

মাখনের মত ফর্সা। কোমর ছাপানো এক ঢাল  লম্বা চুল। রাধার মতো সুন্দরী পুত্রবধূ। খুব আদর পেলেন নতুন বাড়িতে। কিন্তু আট মাস কাটতে না কাটতেই জীবনে মেঘের আনাগোনা। হঠাৎ এক খবরে শাশুড়ী-মা পুত্রবধূকে নিয়ে সঙ্গে গেলেন পুত্রের কর্মস্থলে।

তেরো বছরের রাধারানী দেখলেন বিয়ের সাজে সেজেছেন আট মাস আগে চেনা মানুষটি। কপালে চন্দনের ফোঁটা। গলায় রজনীগন্ধার মালা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বলে উঠেছিলেন, "কী সুন্দর দেখাচ্ছেন!"

তিনি বুঝতে পারেননি। তাঁকে দেওয়া হয়নি স্বামীর খবর। আচমকাই এশিয়াটিক ফ্লু’তে চলে গেছেন সবে চেনা সঙ্গীটি।

বৈধব্যযাপনের জন্য ফিরে আসতে হল বাপের বাড়িতে। কিন্তু এ যেন অচেনা এক বাড়ি। মানুষগুলো বদলে গিয়েছে রাতারাতি। বদলে গিয়েছে ব্যবহার। রাতারাতি বদলে গিয়েছে রাধার জীবন!

মেয়ের বৈধব্য যাপনে যাতে ত্রুটি না হয় তার খেয়াল রাখতে শুরু করলেন কড়া নজরে। প্রথমেই কাঁচি পড়ল এক ঢাল কালো চুলে। মাথা নেড়া। সাদা থান কিনে আনা হল। ব্লাউজহীন, সেমিজহীন এক কাপড়ে। সামান্যতম  গয়নাও দূরঅস্ত। চোদ্দ বছরের কিশোরীর শুরু হল নির্জলা একাদশী পালন। স্নানে যাওয়ার সময় সঙ্গে দেওয়া হল দাসী। নজরদারীর ব্যবস্থা। যাতে স্নানের সময়ে একবিন্দু জলও গলায় না যায়। চুরি করে বা ভুল করে জলে গলা ভিজলে মহাপাতকী হতে হবে যে!

বিয়ের আগে বাবা ব্রাহ্ম সঙ্গীত শেখাতেন ছেলেমেয়েদের। "ওসব মেলচ্ছ ব্যাপারে" মায়ের ঘোর আপত্তি। কিন্তু বাবা ছেলেমেয়েদের মুক্ত মনা হিসেবেই গড়তে চান। বাড়িতে বই-পত্র-মাসিক পত্রিকার চর্চা। প্রত্যেকের নামে নামে পত্রিকা আসে ডাকে। সদ্য কিশোরীর বৈধব্যযাপনে তিনি কিছু বললেন না। অন্দরমহলের মেয়েলি ব্যাপারে তিনি নির্বাক দর্শক। জজ সাহেবের সব বিচার কোর্ট-এজলাসে। 

রাধারাণী একদিন শ্বশুরবাড়ি এলেন। পরনে সাদা থান। ছাঁটা চুল। আভরণহীন অঙ্গ। প্রিয় পুত্রবধূর বেশ দেখেই  মাটিতে বসে পড়লেন শাশুড়ীমা। বললেন, "এ বেশ তিনি আর দেশতে পারছেন না!"

চোদ্দ বছরের কিশোরীর ওপর বৈধব্যযাপনের নামে এমন নির্যাতন মানতে পারলেন না তিনি। বেশ বদল করলেন পূত্রবধূর। সাদা থানের বদলে এল ইঞ্চি পাড় ধুতি। গলায় হার। কানে-হাতে চুড়ি। বড় হতে লাগল চুল। আবার মাথায় শোভা পেতে লাগল খোঁপা। পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। বাড়ির শিশুদের পড়াশোনার দায়িত্ব এল তাঁর ওপর। সব বাচ্চাদের ইনচার্জ। জীবন ফিরে পেলেন। আরও একটি গুরুদায়িত্ব এল তাঁর ওপর। বাড়ির জ্যেষ্ঠ বধূ হিসেবে সংসারের যাবতীয় টাকা-পয়সা আর আর্থিক হিসেবের দায়িত্বে তিনি।  

হারিয়ে যাওয়া শব্দরা আবার ফিরে এলো রাধারানীর কলমে। শুরু হল লেখালেখি। ছোটবেলা থেকে কবিতা লিখতেন। হঠাৎ আসা ঝড় এলোমেলো করে দিয়েছিল বুকের ভিতর লালন করা অক্ষরবাড়িটাকে। আবার নতুন আলোয় সেজে উঠতে লাগল সে বাড়ির দোর-দালান। ঝিনুকের ভিতর থেকে দেখা মিলল চেনা রাধারাণীর। শব্দে, অক্ষরে সজীব সবুজ।

সাহিত্য আসর, সভা-সমিতিতে যাওয়া শুরু করলেন। পত্রিকার দপ্তরে লেখা পাঠানো, লেখা ডাকে দেওয়া সব চলতে লাগল বাধাহীন ভাবে। বাড়ির গাড়িতে, বাড়ির ড্রাইভার পৌঁছে দিয়ে আসত। বাড়ির সবাই ভীষণ খুশি। অন্ধকার দিনের গ্লানিরা তখন প্রাক্তন। কলম দরজা খুলে দিল এক অন্য জীবনের। নব রবি কিরণে, মুক্তির আলোয় বাল্যবিধবা রাধারাণী হয়ে উঠলেন ‘অপরাজিতা’।

তথ্যসূত্রঃ  ( আকাশবাণী মৈত্রী -  আমার মা রাধারাণী দেবী - নবনীতা দেবসেন

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...