যা নিরন্তর যা অবিরাম যা অনন্ত তাকে নতুন করে যা প্রতিনয়ত আসা যাওয়ার মধ্যে তাকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করা, আলাদা করে সাজিয়ে গর্বিত হোয়া খুব কঠিন একটা কাজ। ঠিক সেই জন্যি হয়ত তার বিস্মৃতি, তার হারিয়ে যাওয়ার এই পদ্ধতিটাও ঠিক ততটাই সহজ।
তাকে এত বেশি করে পাওয়ার চেষ্টায় কখন যে সে বিস্মৃতির পথ ধরে তার আন্দাজ পাওয়া যায় না যতক্ষণ না একদিন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় সে। যেমন আমার শহরের স্মৃতি, আমার ছোটবেলা, বড় হয়ে ওঠা, বাড়ি, তার প্রতিটা ঘর, পর্দা, বিছানার চাদর, রান্নাঘরের হাওয়ায় ডালের গন্ধ, গরম ভাতের ভাপ, চায়ের হালকা ঘ্রাণ, রাতের ছাদ, একলা বারান্দা, তপ্ত গরমে কলিং বেল বেজে ওঠা, পাড়ার ঘরে ঘরে ‘এসো হে বৈশাখ’- এত বেশি চর্চা, এত বেশি গান, টিভিতে ‘অতিথি’ দেখে ‘তারাপদ’ নামটার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া, স্কুলে না গিয়ে সারাদিন মনখারাপে কাটিয়ে দেওয়া। নিয়ম মেনে কাজ করে বাহবা কুড়ানোর মধ্যে আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি না তো?
‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ সহজ মনের একটি মানুষকে বোঝানো এই রুক্ষ পৃথিবী নিয়ম মানতে শেখায় নয়ত একদিন বামা ঝি’র মতো শুধু বাসন মাজতে হবে অথচ তোমাকে নিয়ে কেউ একটা ছোট গল্পও লিখবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন বহু যুগ আগে।
এই যে বিলাসিতা, এই যে আত্মহননের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বারে বারে শুদ্ধিকরণের রাস্তায় জবরদস্তি নিয়ে গিয়ে নতুনভাবে আবিষ্কার করা, এই আতিশয্য করার মতো ক্ষমতা এই মানুষটার নেই। এখন আর রবিবার শুধু দুঃখ পাওয়ার আতিশয্য নয়, সোমবারের অপেক্ষায় রোদভরা বিছানায় শুয়ে গোটা একটা গল্প লিখে দারুণ একটা আনন্দবোধ করা নয়, সোমবারের আগে রবিবারের সঙ্গে গোটা সপ্তাহের কী কী কাজ, তার প্রস্তুতি নেওয়া।
পাশের বাড়ির টেপ রেকর্ডারে তখন চিত্রাঙ্গদা বাজছে, কিন্তু আমায় তখন স্ট্যাটিসটিএক্সে মন দিতে হবে। খুব খারাপ ভবিষ্যৎ আমার। আমি বংশগতভাবে সুখ দুঃখ নিয়ে রচনাবলী লিখে ফেলব এমন সুযোগ আমি পাব না। আমার সীমা মাকেই মেপে নিতে হবে। আর তা সীমিত।
আজ ২৫ বছর পর যখন চায়ের জল ফুটে ওঠে, বাষ্প তৈরি হয় কাচের কেটলিতে, তার তাপ যখন আমার মধ্যবয়সী মধ্যবিত্ত এই মুখ স্পর্শ করে তখন খুব কান্না পায়। ক্লান্ত গলায় তখন গুনগুন করি আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায়...
যা গিয়েছে, তা যে গিয়েও যায়নি, যা এই রোজ আসা-যাওয়ার মাঝে নিরন্তর রয়ে গিয়েছে আমি তাকে আজকাল শুধু ওই জলের বাষ্পের মতো মাঝে মাঝে দেখতে পাই। তার উষ্ণ আদ্রর্তা অনুভব করি মাত্র, কিন্তু তাকে ছুঁয়ে দেখার ধৃষ্টতা আজ আর নেই। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে আজ এক তেমনি অনুভূতি, তেমনি ভাবনা, তেমনি ধৃষ্টতা। অনেকটা নিজের ভিতর গোটা বিশ্বকে খুঁজে পাওয়ার মতো । একটা একাকীত্ব লাগে। একতু নিরালা চাই। একটু সাধনা। একটু স্বার্থপরতা। আর অনেকখানি বিচ্ছিন্নতা। বাস্তবের সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত পাঠ্যপুস্তক দিয়ে। আর পাঁচজনের মতৈ সহজপাঠের হাত ধরে । না বুঝে শুধু ওই সাদা-কালো ছবির টান। লাইন আর্ট আর নন্দলাল বসুর ইলাস্ট্রেশন আর সহজ ভাষার জন্য মুখস্থ করতে সুবিধা এই ছিল সম্পর্ক মাত্র। তারপর স্কুল আর পাড়ার বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, গানের আসর- পু জো পার্বণেড় মতো গতানুগতিক একটা ধারাবাহিক ২৫ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ- এসব বহুবার না বুঝে, না চেয়ে পালন করেছি। অনেকটা যেন ভাল ছাত্রীর সিলেবাস কমপ্লিট করার মতো। কিন্তু রবীন্দ্র সংস্কৃতির ধারা আমার জীবনে প্রবেশ করার রাস্তাটা একেবারে হঠাৎ ছিল।
কলেজে পড়াকালীন আমার এক বান্ধবী দেখতাম অনেক দূর থেকে ট্রেন জার্নি করে আসত। গরম, ভিড়, ঘাম, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও হাতে একটা বই নিয়ে কলেজে ঢুকত। খুব কৌতুহলে একদিন জানতে চাইলাম কী বই থাকে তার সঙ্গে? এমন কী আছে তাতে যা এই অসহনীয় ঘেমো ভিড় ভুলিয়ে দেয়?
উত্তরে জানলাম আমার বান্ধবী প্রবলভাবে প্রেমে পড়িছে ‘অমিত’-এর। ‘শেষের কবিতা’র অমিত রে। সে এমনই এক লেখা যেখানে অমিতের প্রেমিকা অর্থনীতির ছাত্রী ‘লাবণ্য’ ট্রেনে এক পায়ে দাঁড়িয়েও সাবলীলভাবে এক অনিবার্য ঐতিহাসিক প্রেমিকা হয়ে উঠতে পারে। সেই আমার প্রথম কৌতুহল রবীন্দ্রনাথের লেখা, তার ভাষা, লেখনীর মাধুর্য্য, রুচিশীলতার হাত ধরে ওই একটা একটা করে দরজা খোলার ইচ্ছে জাগতে থাকে। একটা একটা করে দরজা আমি খুলতে থাকি। তাঁর কাছে পৌঁছনোর তাগিদ, তাকে গ্রহণ করার এক নেশা হঠাৎ করে আমাকে আচ্ছন্ন করে। পড়তে চাওয়ার খিদে বাড়তে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ একজন কবি, গীতিকার, নাট্যকার, শিল্পী, সমাজ সংস্কারক। তাঁর বাচনভঙ্গী, নান্দনিকতা, শিল্পচেতনা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মার্জিনালাইজড কিছু ভাবনা যেমন- একটা সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম নিজের কন্যাদের অল্পবয়সে বিবাহদানের নেপথ্য কারণ। তাঁর এই সব দ্বন্দই তাঁকে দেবতার আসন থেকে দোষে গুণে মাটির মানুষ করেছে আমার কাছে। তাঁকে মনে হয়েছে এমনই এক মানুষ যিনি প্রচণ্ডভাবে ডিসিপ্লিনড আর্টিস্ট, যাঁর কাছে শিল্পের চেয়ে বড় আর কিছু হয়ত হয় না। সম্পর্ক, জন্ম, মৃত্যু জাগতিক ভাঙ্গা গড়া কোনওটাই নয়। তার সঙ্গে সঙ্গে কিছু খামতি, কিছু বাদ পড়ে যাওয়া-এগুলোই তাঁকে ভগবানের সিংহাসন থেকে রক্ত মাংসের করে তুলেছে আমার চোখে।
প্রথম প্রথম বেশ খারাপ লেগেছিল এসব খামতি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ দেবতাসমান এভাবেই তোকে জানতে চেয়েছি তাঁকে আমরা আর এটাই স্বাভাবিক কিন্তু পরে বুঝতে শিখেছি এই ভুল-ভ্রান্তি দ্বন্দ মিলিয়ে মানুষটিই অনেক বেশি মনের কাছাকাছি, অনেক বেশি সহনীয়।